খবরে আমরাঃ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একনিষ্ঠ সতীর্থ রাজ্যের আইনমন্ত্রী মলয় ঘটকের হাত ধরেই প্রথমবার আসানসোল লোকসভা আসন দখল করল তৃণমূল। জয়ী হয়েছেন বিহারীবাবু শত্রুঘ্ন সিনহা। প্রথমবার জিতে জয়ের ব্যবধানও প্রায় ৩ লক্ষ ভোটের কাছে। যা প্রায় রেকর্ডেরই সামিল। আসানসোল লোকসভা ভোটের উপনির্বাচন ঘোষণার পরেই আসানসোলের (উত্তর) বিধায়ক মলয় ঘটকের হাতেই শত্রঘ্কে জিতেয়ে আনার ভার তুলে দিয়েছিলেন মমতা। এবার সেই দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। শত্রঘ্ন ভোটের ময়দানে প্রার্থী হলেও পিছন থেকে ভোটে জিতিয়ে আনার কারিগর মলয়ই। তারই সুচতুর চালে কিস্তিমাত হয়েছে। মুখ থুবড়ে পড়েছে গেরুয়া। যে আসানসোলের হিন্দিভাষী ভোটকে সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্বের তাসে ধরে রেখে বিজেপি জদিতে এসেছে এবার সেই মিথকে ভেঙে আবারও মলয় প্রমাণ করে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রীর এই সৈনিক তাঁরই দেখানো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পথেই চলেছেন। ঘোট ঘোষণার দিন থেকেই সারথীর মতো শত্রুঘ্কে নিয়ে ছুটেছেন আসানসোল লোকসভার প্রতিটি অংশে্, একের পর এক বৈঠক করে দলীয় কর্মীদের মনোবল বাড়িয়েছেন মলয়। আর সাজিয়েছেন যুদ্ধ জয়ের ঘুঁটি। তাই জয তৃণমূলের, জয় শত্রুঘ্ন খাতায় কলমে হলেও আসল জয় শথ্রুঘ্নর কৃষ্ণ সারথী মলয় ঘটকের।
১৯৭৫ সালে ছাত্র পরিষদের হাত ধরে রাজনৈতিক জীবনে প্রবেশ মলয়ের। আসানসোল ব্লক যুব কংগ্রেসের সভাপতি, অবিভক্ত বর্ধমান জেলা যুব কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদকের পদ সামলানো মলয় ১৯৯৮ সালে তৃণমূলের জন্মলগ্ন থেকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিশ্বাসভাজন। তৃণমূলের জেলা সভাপতি, জেলা চেয়ারম্যান, শ্রমিক সংগঠনের আইএনটিটিইউসি-র রাজ্য সাধারণ সম্পাদক, এমন নানা দায়িত্ব সামলেছেন তিনি। ২০১১ থেকে টানা আসানসোল উত্তর কেন্দ্রের বিধায়ক মলয়়। বর্তমানে তিনি রাজ্যের আইনমন্ত্রী।
বিগত লোকসভা নির্বাচনে আসানসোলে কখনই ঘাসফুল ফোটেনি। সে কারণে এই উপনির্বাচন তৃণমূলের কাছে বেশ চ্যালেঞ্জিংই ছিল। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় আসানসোলে প্রচারে গিয়েও সেকথা বলেছিলেন। সকলের কাছে ভোট প্রার্থনা করেছিলেন। এবার উপনির্বাচনে কাটল খরা। ২০১৪, ১০১৯ সালে জয় না মিললেও ২০২২ সালের উপনির্বাচনে আসানসোলে ঘাসফুল ফোটালেন শত্রুঘ্ন সিনহা। ২ লক্ষ ৯৭ হাজার ভোটে জয়ী তিনি। আসানসোলবাসী যেভাবে গ্রহণ করেছে তাঁকে, তাতে বেশ আহ্লাদিত ‘বিহারীবাবু’। স্বামী জয়ী হওয়ার প্রার্থনায় মন্দিরেও যান শত্রুঘ্নের স্ত্রী পুনম। তৃণমূল শিবিরের কাছে কার্যত পর্যুদস্ত বিজেপি। নিজের কেন্দ্রে বেশ পিছিয়ে অগ্নিমিত্রা পল। তৃতীয় স্থানে সিপিএম।
কী কারণে আসানসোল ও বালিগঞ্জে এত খারাপ ফলাফল বিজেপির? এ প্রসঙ্গে রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের দাবি, হিন্দু এলাকায় বহুতল থেকে অনেকেই ভোট দেননি বলে বালিগঞ্জে খারাপ ফলাফল বিজেপির। যদিও ফিরহাদ হাকিম সে দাবি মানতে নারাজ। রাজ্যবাসী যে আর বিজেপিকে সমর্থন করে না তা উপনির্বাচনেই স্পষ্ট বলে দাবি তৃণমূল নেতার।
অন্যদিকে, শত্রুঘ্নর সিনে-দুনিয়া ছেড়ে তাঁর রাজনীতির আঙিনায় পদার্পণ অনেক দিন হল। কিন্তু সভা মঞ্চে শত্রুঘ্ন সিন্হা এসে দাঁড়ালে ঘুরে ফিরে আসে ‘খামোশ’ সংলাপ। সেই ঢঙেই আসানসোলে বিজেপি-কে ‘খামোশ’ করিয়ে দিলেন বলিউডের এক সময়ের ‘অ্যাংরি ইয়ংম্যান’। উপনির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থী হয়ে বলেছিলেন ‘ঐতিহাসিক জয়’ এনে দেবেন। শনিবারের বারবেলায় তৃণমূলের হয়ে কার্যত ইতিহাসই গড়লেন ৭৩ বছরের ‘বিহারিবাবু’। বিজেপিকে ‘খামোশ’ (চুপ) করিয়ে তাদের দু’বারের জেতা আসনে ২ লক্ষ ৯৭ হাজার ভোটে জিতলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী জমানার এই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। বিজেপি ছেড়ে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিহার থেকে কংগ্রেসের প্রার্থী হয়েছিলেন শত্রুঘ্ন। কিন্তু বিজেপি-র প্রার্থী রবিশঙ্কর প্রসাদের কাছে হেরে যান। রাজনীতির তৃতীয় ইনিংস শুরু করলেন তৃণমূল দিয়ে। আর প্রথমেই ছক্কা। শনিবার ফল ঘোষণার প্রথম দিকে কিছুটা লড়াই দিয়েছিলেন বিজেপি প্রার্থী অগ্নিমিত্রা পাল। কিন্তু বেলা যত বাড়ে, ততই প্রতিদ্বন্দ্বীকে পিছনে ফেলে তরতর গতিতে এগিয়েছেন শত্রুঘ্ন। ৩৭ হাজার থেকে ৬৮ হাজার হয়ে এক লাখ তার পর ১ লাখ ৪০ হাজার… ভোটের ফারাক বাড়তে থাকে। শত্রুঘ্ন ভাঙছেন বাবুলের রেকর্ডও।
গত বিধানসভা ভোটে বিজেপির বিরুদ্ধে তৃণমূলের ‘বহিরাগত’ তত্ত্বকে আসানসোলে ব্যুমেরাং করতে চেয়েছিল গেরুয়া শিবির। যদিও প্রচারে নেমে ‘শটগান’ শত্রুঘ্নের জবাব ছিল তিনি বিহারের মানুষ বটে, কিন্তু বাংলার সঙ্গে তাঁর গভীর সম্পর্ক। তাঁর কথায়, ‘‘জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ছবিতেও আমি অভিনয় করেছি। আসানসোল শুধু বাঙালি নয়, বিহার, ঝাড়খণ্ড-সহ অন্যান্য রাজ্য থেকে আসা মানুষের বাসভূমি।’’ রাজনীতিক মহলের মতে, ঠিক ওই অঙ্কেই আসানসোলে বিজেপি-কে ঘায়েল করেছে তৃণমূল। শনিবার ভোটের ফলেও দেখা গেল সত্যিই বিজেপি-র ‘বহিরাগত তত্ত্ব’ ছাপ ফেলেনি আসানসোলে।
শত্রুঘ্নের আসানসোল জয়ের পিছনে আরও কারণ আছে। আসলে রাজ্যজুড়ে তাদের জয়জয়কার হলেও এত দিন আসানসোলে দাঁত ফোটাতে পারেনি তৃণমূল। একদা বামেদের গড় আসানসোলে ২০১৪ সালে প্রথমবার পদ্ম ফোটান বাবুল। ১৯’-এর লোকসভা ভোটেও তৃণমূলের মুনমুন সেনকে রেকর্ড ব্যবধানে হারিয়ে দ্বিতীয় বার মোদীর মন্ত্রিসভায় জায়গা করে নেন তিনি। সেই বাবুল এখন তৃণমূলে। এবং শত্রুঘ্নের আসানসোল জয়ের দিনেই তিনি জিতে ফেলেছেন বালিগঞ্জ বিধানসভা। তাই বাবুলের ছেড়ে যাওয়া আসনে জয় আনতে তৃণমূলকে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। রাজনৈতিক কারবারিদের মতে, বাবুলের পদত্যাগ এবং বিজেপি-র দুর্বল সংগঠনই শত্রুঘ্নের জয় সহজ করে দিয়েছিল। তা ছাড়া আসানসোলে তৃণমূলত্যাগী জিতেন্দ্র তিওয়ারি বিধানসভা ভোটে বিজেপি-কে জয় এনে দিতে পারেননি। গত ফেব্রুয়ারিতে আসানসোল পুরভোটেও তৃণমূল জয় পেয়েছে। তাই আসানসোলে এ বার হাতে আসবে, তা আশা করেছিল তৃণমূল। তবে জয়ের ফারাক এমন হবে সেটা বোধহয় কেউই ভাবেননি।