www.machinnamasta.in

ওঁ শ্রীং হ্রীং ক্লী গং গণপতয়ে বর বরদ সর্বজনস্ময়ী বশমানয় ঠঃ ঠঃ

May 19, 2024 2:18 am
chaitra sankranti

বাংলা এবং বাঙালির জীবনে চৈত্র সংক্রান্তির তাৎপর্যই আলাদা। এই দিনটি আসলে বসন্তের বিদায়ে গ্রীষ্মের সূচনা। এমন এক দিন প্রাচীনকাল থেকে বাংলার বুকে এক অপরিসীম তাৎপর্য বহন করছে। গ্রীষ্ম মানে রুখা-শুখা, গ্রাম-বাংলার বুক থেকে যেন মাটির রস এবং জীবনের রস শুষে নিতে চায় প্রকৃতি। আসলে প্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত যে এই রুখ-শুখা প্রকৃতির আগমন নতুন করে এবং নতুন রূপে কিছু পাওয়ার জন্য। আর সেই জন্যই চৈত্র সংক্রান্তির অবতারণা।

চৈত্র মাস মানেই মেলা আর উৎসবের ফুলঝুরি। আর নতুন বাংলা বর্ষ আসার প্রতীক্ষা। চৈত্র মাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় দিনটি হল চৈত্র সংক্রান্তি। এই দিনটিকে অবলম্বন করে বাংলার বুকে রয়েছে একাধিক লোকাচার থেকে পূজা-আর্চা এবং সামাজিক বিধি। যাদের কাহিনি বেশ আকর্ষণ করার মতো। আর এই চৈত্র সংক্রান্তির কাহিনির মধ্যে দিয়ে সামনে আসে বাংলার সমাজজীবনের চালচিত্র এবং জনজীবন ও সংস্কৃতি। যা বাংলা ভাগের পরও আজও অমলিন। চৈত্র সংক্রান্তি মূলত হিন্দু প্রধান উৎসব হলেও বাংলার মুসলিম সমাজেও সমানভাবে সমাদৃত। আর এই বাংলার বুকে চৈত্র সংক্রান্তি মুসলিমদের কাছেও সমান মূল্য ও তাৎপর্য এবং ঐতিহ্য বহন করে। 

কেন চৈত্র সংক্রান্তি
চৈত্র সংক্রান্তি (Chaitra Sankranti) হল চৈত্র মাসের শেষ দিন। এই দিনের শেষ মানেই বাংলায় নতুন বছরের সূচনা। মানে পয়লা বৈশাখ (Bengali New Year) । যা বাংলা নববর্ষ মানেই পরিচিত। লোককথায় প্রচলিত রয়েছে যে চৈত্র মাস এবং তার শেষ দিন যেহেতু সংক্রান্তি তাই এই দুইয়ে মিলে তৈরি হয়েছে চৈত্র সংক্রান্তি শব্দটি। বাংলার জনজীবনে সবচেয়ে বেশি মেলা এবং উৎসব নাকি হয় এই চৈত্র সংক্রান্তিতে। প্রাচীনকাল থেকেই বাংলা পঞ্জিকায় চৈত্র সংক্রান্তি এক পবিত্র এবং উৎসবমুখর দিন হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আসছে। 

বাংলার সমাজজীবনে দুই মাস চৈত্র ও বৈশাখ- কীভাবে চৈত্রমাস ও বৈশাখ মাসের নামকরণ 
লোককথায় প্রচলিত যে দক্ষরাজ তাঁর ২৭ মেয়ের নামকরণ করেছিলেন ২৭টি নক্ষত্রের নাম থেকে। এই দক্ষরাজের এক মেয়ের নাম ছিল চিত্রা এবং অন্য এক মেয়ের নাম ছিল বিশাখা। চিত্রা নামটি নাকি দক্ষরাজ নিয়েছিলেন তিক্রা নক্ষত্র থেকে। পরবর্তী সময়ে দক্ষরাজের কন্যা চিত্রা-র নাম থেকে জন্ম হয় চৈত্র মাসের। আর এক কন্যা বিশাখার নাম থেকে নাকি জন্ম নিয়েছিল বৈশাখ মাস। লোককথায় এমনই দাবি করা হয়েছে। আর এই কাহিনি আজও এপার এবং ওপার বাংলায় প্রচলিত।

চৈত্র সংক্রান্তিতে শাকান্ন উৎসব 
চৈত্র সংক্রান্তির দিনে গ্রাম-বাংলার বউ-ঝিরা ঝোপ-জঙ্গল থেকে প্রথা মেনে ১৪ রকমের শাক তুলে আনতেন। সেই শাক একসঙ্গে রেঁধে এই দিনে খাওয়া হয়। আজও পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের বহুস্থানে এইভাবে ঝোপ-জঙ্গল থেকে শাক তুলে এনে খাওয়ার রীতি রয়েছে। এই প্রথা শাকান্ন উৎসব নামে পরিচিত। কোথাও কোথাও চৈত্র সংক্রান্তির দিনে নিরামিশ খাওয়ার প্রথা রয়েছে। এই দিন ভিটে-মাটিতে মাছ-মাংস আনা এই সব স্থানে নিষেধ। 

চৈত্র সংক্রান্তিকে অবলম্বন করেই হালখাতা উৎসবের জন্ম
জমিদারির খাজনার হিসাব-নিকেশ হতো চৈত্র সংক্রান্তির দিনে। সারাবছর কে কত খাজনা জমা করেছে, কার কত খাজনা বাকি রয়েছে তা চৈত্র সংক্রান্তির মধ্যে চূড়ান্ত হতো। এরপর বৈশাখের প্রথম দিনে, বাংলা নববর্ষের দিনে নতুন খাতায় সেই হিসাব তোলা হত। এই প্রথা হালখাতা নামে পরিচিত। পরবর্তীকালে এই হালখাতার চল দোকানে-দোকানে ছড়িয়ে পড়ে। দোকান মালিকরাও তাদের ক্রেতাদের হিসাব-নিকেশ নতুন খাতায় তুলে রাখতে শুরু করেন নববর্ষের দিনে। যার ফলে হালখাতা উৎসব এক ব্যাপক আকার নেয়। হালখাতার এই উৎসব আজ অনেকটা ম্লান হলেও আনন্দের ঘনঘটা এখনও রয়েছে। গ্রাম-বাংলায় আজও এই হালখাতা নিয়ে মানুষ আনন্দে মেতে থাকে। 

চৈত্র সংক্রান্তিতে গমের ছাতুর শরবত
চৈত্র সংক্রান্তিতে যেমন খাজনার নতুন হিসেব হত। তেমনি এই দিনের পরের দিব পয়লা বৈশাখে গ্রাম-বাংলায় গমের ছাতু, দই, পাকা বেল দিয়ে তৈরি বিশেষ শরবত খাওয়ারও প্রচলন বহুকাল থেকে। 

চৈত্র সংক্রান্তিতে তালতলার শিরনি
চৈত্র সংক্রান্তিতে গ্রাম-বাংলার আরও এক বিশেষ উৎসব তালতলার শিরনি। এই দিনে প্রতিটি বাড়ি থেকে চাল-তালের গুড়, দুধ সংগ্রহ করা হয়। যে বাড়িতে এগুলো থাকে না তারা অর্থ দিয়ে দেয়। এরপর গ্রামের কোনও পবিত্র তাল গাছের নিচে বা বটগাছের নিচে এই জিনিসগুলো দিয়ে তৈরি হয় শিরনি। যা তালতলার শিরনি নামে পরিচিত। এরপর তা গ্রামের মানুষের মধ্যে বিলি করে দেওয়া হয়। 

চৈত্র সংক্রান্তিতে নীল উৎসব 
 লাল কাপড় পরে মাথায় পাগড়ি বেঁধে, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা এবং হাতে ত্রিশূল নিয়ে শিবের সাজ, সঙ্গে আবার দেবী পার্বতীর সাজে কেউ একজন, এদের সঙ্গে আবার খোল-করতাল, ঢাক-ঢোল নিয়ে কিছু জন। দলটির মধ্যে একজন আবার পাগল সাজে থাকে। যাকে হনু বলে পরিচয় দেওয়া হয়। এরা দলে দলে বাড়ি বাড়ি ঘোরে এবং শিব-পার্বতীর গান গেয়ে মিনিট ১০-এর অনুষ্ঠান করে। এই সঙ সাজের দলকে নীল বলে। এদের আবার একজন দলপতি থাকে যিনি বালা নামে পরিচিত। যিনি নীল ঠাকুরকে হাতে ধরে থাকেন। বাড়ির উঠোন লেপে বা কোনও গৃহস্থ উঠোনে আলপনা দিয়ে দেয়। সেখানেই নীলকে প্রতিষ্ঠা করে চলে নীলের নাচ বা শিবের গাজন। এটাই নীল উৎসব নামে পরিচিত। 

চৈত্র সংক্রান্তিতে গম্ভীরাপূজো
এই দিনের আরও একটি বড় আচার এবং অনুষ্ঠান হল গম্ভীরা নাচ। আজও বরেন্দ্র অঞ্চল এবং বাংলাদেশের রাজশাহীতে চৈত্র সংক্রান্তির দিনে গম্ভীরার প্রচলন রয়েছে। বরেন্দ্র অঞ্চল বলতে এপার বাংলার মালদহ, দুই দিনাজপুরে চৈত্র সংক্রান্তিতে গম্ভীরা নাচ হয়। গম্ভীরা নাচের সঙ্গে হয় গম্ভীরা পূজো এবং শিবের গাজন।  

চৈত্র সংক্রান্তির আরও এক উৎসব বিজু বা বৈসাবি
বাংলাদেশের মধ্যে এখন পড়ে চাকমা এলাকা। এই চাকমার বাসিন্দারা চাকমা নামে পরিচিত। এখানে চৈত্র সংক্রান্তিতে একটি বিশেষ পরব অনুষ্ঠিত হয়। এর নাম বিজু বা বৈসাবি। এই নামকরণের পিছনেও রয়েছে এক ইতিহাস। কারণ, বৈসাবি নামের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে ত্রিপুরার বৈসু, মারমাদের সাংগ্রাই ও চাকমাদের বিজু উৎসব। এই উৎসবের আদ্যাক্ষরগুলো নিয়ে তৈরি হয়েছে বৈসাবি। তবে, বিজু বা বৈসাবী পালিত হয় দুদিন ধরে। চৈত্র সংক্রান্তি এবং পয়লা বৈশাখ নিয়ে এই উৎসব। এছাড়াও চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন হয় ফুল বিজু উৎসব। ওই দিনে চাকমা মেয়েরা পাহাড়ে যায় ফুল সংগ্রহ করতে। সংগ্রহ করা ফুলকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। এক ভাগ দিয়ে বুদ্ধদেবকে পূজা করা হয়। এক ভাগ জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয় এবং বাকি এক ভাগ দিয়ে ঘর সাজানো হয়। চৈত্র সংক্রান্তির দিনে পালিত হয় মূল বিজু। এই দিন সকালে বুদ্ধদেবের মূর্তিকে স্নান করানো হয়। ছেলে-মেয়েরা তাঁদের বৃদ্ধ দাদু-দিদিমাকে নদী বা কাছের জলাশয় থেকে জল বয়ে নিয়ে এসে স্নান করিয়ে আশীর্বাদ নেয়। 

চৈত্র সংক্রান্তিতে পাজন (Gajan)
চাকমাদের ঘরে এই রন্ধনের আয়োজন হয়। এটি পাজন নামে পরিচিত। পাজন হল নানা সবজির মিশালি এক তরকারি। এই দিন বাড়িতে যে সব বন্ধু বা অতিথিরা আসে তাদের এই পাজন দিয়ে আপ্যায়ণ করেন চাকমারা। তাদের ধারণা বছর শেষের দিনে সব ধরনের সবজি দিয়ে তরকারি খেলে মঙ্গল। এতে নতুন বছরে শুভ সূচনা হয়। এই দিনে চাকমাদের মধ্যে বিবাহিতরা শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে যায়। এটাও তাদের প্রথার মধ্যে পড়ে। সেই সঙ্গে এই দিন অনেক চাকমা আবার বাড়ি মেরামতি করে। জুম চাষের (Spirituality) জন্যও প্রস্তুতি নেয় তারা। 

ত্রিপুরায় চৈত্র সংক্রান্তি
চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন ত্রিপুরায় বসবাসকারী মানুষজনও বাজার অথবা পাহাড় থেকে ফুল সংগ্রহ করে। চৈত্রের শেষ দুদিন এবং নববর্যের প্রথম দিন নিয়ে ত্রিপুরায় পালিত হয় বৈসু উৎসব। দিন অনুযায়ী এর আবার নাম রয়েছে। চৈত্র সংক্রান্তির আগের  দিন একে হারি বুইসুক বলে। চৈত্র সংক্রান্তির দিন এই উৎসবকে বলা হয় বুইসুকমা। এই সময় ত্রিপুরার ছেলে-মেয়েরা যে ফুল সংগ্রহ করে তা দিয়ে ঘর সাজানো হয়। এছাড়াও, মেয়েরা ভোরবেলায় গৃহপালিত পশুদের খোয়াড় থেকে ছেড়ে দেয়। ঝুড়িতে ধান নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে মোরগ ও মুরগীদেরকে তা খাওয়ায়। অনেকেবার বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বন্ধু-বান্ধব অথবা পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের সঙ্গে দেখা করে। এই দিন ত্রিপুরায় ব্যাপকভাবে পিঠার আয়োজনও হয়। 

(সংগৃহীত)

administrator

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *