গ্রহ বা নবগ্রহ হল হিন্দু জ্যোতিষশাস্ত্রের কিছু পরিচিত প্রতীক৷ এই নয়টি প্রতীক যা, সৌরজগতের গ্রহসমূহের সাথে তুলনীয় ৷ যেমন :সূর্যদেব(সূর্য), চন্দ্রদেব(চন্দ্র), মঙ্গলদেব(মঙ্গল), বুধদেব(বুধ), বৃহস্পতি(বৃহস্পতি গ্রহ), শুক্র(শুক্র গ্রহ), এবং শনিদেব(শনি), রাহু ও কেতু ৷
গ্রহগতি বিচার করেই ফলিত জ্যোতিষে (Astrology) গণনা করা হয়। জ্যোতিষশাস্ত্র অনুযায়ী গ্রহ দুর্বল থাকলে তার সঙ্গে জড়িত অশুভ ফল ব্যক্তিকে ভোগ করতে হয়। আবার গ্রহ মজবুত থাকলে, প্রত্যক্ষ লাভ মেলে। দুর্বল গ্রহকে মজবুত করার জন্য এমন কিছু মন্ত্র আছে, (Spirituality) যার জপ করলে শুভ ফল পাওয়া যেতে পারে।
সূর্য- (Sun) জ্যোতিষ মতে, সূর্য গ্রহদের রাজা। মান-সম্মান, চাকরি ও সমৃদ্ধশালী জীবনের জন্য সূর্যের আশীর্বাদ জরুরি। এর জন্য সূর্যের বীজ মন্ত্র জপ করা উচিত। এই মন্ত্রটি হল ‘ওম হাং হীং হৌং সঃ সূর্যায় নমঃ’। রবিবার সকালে স্নানের পরে ১০৮ বার এই মন্ত্র জপ করা উচিত।
চন্দ্র- (Moon) চন্দ্র দোষের ফলে কলহ, মানসিক বিকার, মা-বাবার অসুস্থতা, দুর্বলতা, অর্থাভাবের মতো সমস্যা দেখা দেয়। চন্দ্র মনের কারক গ্রহ। চন্দ্রকে মজবুত করার জন্য ‘ওম শ্রাং শ্রীং শ্রৌং সঃ চন্দ্রমসে নমঃ’। সোমবার সকালে ১০৮ বার এই মন্ত্র জপ করতে হবে।
মঙ্গল- (Mars) মঙ্গল সাহস ও পরাক্রমের কারক গ্রহ। কুষ্ঠিতে মঙ্গল দুর্বল হলে ব্যক্তির সাহস ও শক্তি অভাব দেখা দেয়। এ ক্ষেত্রে মঙ্গলের বীজ মন্ত্র ‘ওম ক্রাং ক্রীং ক্রৌং সঃ ভৌমায় নমঃ’ জপ করা উচিত। মঙ্গলবার সকালে স্নান-ধ্যনের পর ১০৮ বার এই মন্ত্র জপ করতে হবে।
বুধ- (Mercury) জীবনে উন্নতি ও প্রসিদ্ধির জন্য বুধের মজবুত হওয়া জরুরি। বুধের বীজমন্ত্রেরও ১০৮ বার জপ করা উচিত। এই মন্ত্রটি হল, ‘ওম ব্রাং ব্রীং ব্রৌং সঃ বুধায় নমঃ’।
বৃহস্পতি- (Jupiter) কুষ্ঠিতে বৃহস্পতির শুভ প্রভাবের ফলে ধন লাভ, সুখ-সুবিধা, সৌভাগ্য, দীর্ঘায়ু লাভ করা যায়। বৈবাহিক জীবনের সঙ্গে জড়িত সমস্যা ও দেবগুরু বৃহস্পতিকে শক্তিশালী করার জন্য ‘ওম গ্রাং গ্রীং গ্রৌং সঃ গুরুবে নমঃ’ মন্ত্রের জপ করা উচিত। রোজ সন্ধেবেলা ১০৮ বার এই বীজ মন্ত্রের জপের ফলে সুফল পাওয়া যায়।
শুক্র- (Venus) শুক্র মজবুত হলে সমস্ত ধরণের ঐশ্বর্য লাভ করা যায়। শুক্রবার সকালে স্নানের পর ‘ওম দ্রাং দ্রীং দ্রৌং সঃ শুক্রায় নমঃ’ মন্ত্র ১০৮ বার জপ করা উচিত।
শনি- (Saturn) জ্যোতিষে শনিকে কর্মফলদাতা বলা হয়েছে। কুষ্ঠিতে শনি ভারি থাকলে জীবনে নানান সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। তাই সমস্যা থেকে মুক্তির জন্য ‘ওম প্রাং প্রীং প্রৌং সঃ শনৈশ্চরায় নমঃ’ মন্ত্রের জপ করা উচিত। এ ক্ষেত্রে শনিবার সন্ধে নাগাদ ১০৮ বার এই মন্ত্র জপ করা উচিত।
রাহু- (Rahu) রাহু একটি ছায়া গ্রহ। অবসাদ কমানোর জন্য রাহু মন্ত্র জপ করা উচিত। কুষ্ঠিতে রাহু অশুভ পরিস্থিতিতে থাকলে ব্যক্তি সহজে সাফল্য পায় না। এ ক্ষেত্রে রাহুর বীজ মন্ত্র ‘ওম ভ্রাং ভ্রীং ভ্রৌং সঃ রাহবে নমঃ’ -র জপ করা উচিত। রোজ রাতে ১০৮ বার এই মন্ত্র জপ করলে সুফল পাওয়া যায়।
কেতু- (Ketu) রাহুর মতোই কেতুও একটি ছায়া গ্রহ। এর কোনও বাস্তবিক রুপ নেই। কেতুর অশুভ প্রভাবের ফলে জীবনে কলহ লেগেই থাকে। কলহ থেকে মুক্তির জন্য ‘ওম স্রাং স্রীং স্রৌং সঃ কেতবে নমঃ’ মন্ত্রের জপ করা উচিত। এই মন্ত্রও রোজ রাতে ১০৮ বার জপ করলে সুফল পাওয়া যেতে পারে।
নবগ্রহ প্রণাম মন্ত্র:- (Navagraha Pranam Mantra)
“ওঁ জবাকুসুমসংকাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিম্ ।
ধ্বান্ত্যারিং সর্বপাপঘ্নম্ প্রণতোহশ্মি দিবাকরম্ ॥
দিব্যশঙ্খতুষারাভং ক্ষীরোদার্নভসম্ভবম্ ।
নমামি শশীনং ভক্তা শম্ভোর্মুকুটভূষণম্ ॥
ধরণীগর্ভোসম্ভূতং বিদ্যূতপুঞ্জসমপ্রভম্ ।
কুমারং শক্তিহন্তস্চ লোহিতাঙ্গং প্রণম্যহং ॥
প্রিয়ঙ্গুকলিকাশ্যমং রূপেনাপ্রতিমং বুধম ।
সৌম্যং সৌম্যগুণপেতং নমামি শশীনংসুতম্ ॥
দেবতানাংম্রিশিনান্চং গুরুং কনকসন্নিভং ।
বন্দে ভক্তা ত্রিলোকেশং ত্বং নমামি বৃহস্পতিম্ ॥
হিমকুন্দমৃণালাভং দৈত্যানাং পরমং গুরুম্ ।
সর্বশাস্ত্রপ্রবক্তারং ভার্গবং প্রণম্যহ্ ॥
নিলাঞ্জনংচয়প্রক্ষ্যং রবিসূতং মহাগ্রহম্ ।
ছায়ায়ং গর্ভসম্ভূতং বন্দেভক্তা শণৈশ্চরম ॥
অর্দ্ধকায়াং মহাঘোরং চন্দ্রাদিত্যবিমর্দকম
সিংহিকায়া মহারৌদ্রং ত্বং রাহুং প্রণম্যহম্ ॥
পলাশধূমসংকাশং তারাগ্রহবির্মদকম ।
রৌদ্রং রৌদ্রত্বকং ঘোরং ত্বং কেতুং প্রণম্যহম্ ॥”
নবগ্রহ স্তব:-
নবগ্রহ স্তব ও গায়ত্রী মন্ত্র জপ করার কারণ- অশুভ শক্তিকে পরাহত করে শান্তি লাভ করতে নবগ্রহ স্তব ও গায়ত্রী মন্ত্র জপ করা অপরিহার্য।
“গোচরে বা বিলগ্নে বা সে গ্রহারিষ্টসূচকাঃ।
পূজয়ে তান্ প্রযন্তেন পূজিতাঃ স্যুঃ শুভপ্রদাঃ||”
• উপরিক্ত মন্ত্রের বাংলা অর্থ-
(গোচরে বা জন্মকুণ্ডলীতে যে গ্রহ অনিষ্টকারক , তার শান্তি করিয়ে প্রসন্নতা লাভ করানো প্রয়োজন। প্রসন্ন হয়ে সেই গ্রহ শুভ ফল প্রদান করেন। নবগ্রহ স্তব ও গায়ত্রী মন্ত্র জপের দ্বারা গ্রহগণের শান্তি অতি শীঘ্রই হয়ে থাকে অর্থাৎ নবগ্রহের শান্তি মানে আমাদের শান্তি)।
নবগ্রহ স্তোত্রম্ :- (Navagraha Stotram)
জবাকুসুমসঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিম্।
ধ্বান্তারিং সর্বপাপঘ্নং প্রণতোহস্মি দিবাকরম্।।
দিব্যশঙ্খতুষারাভং ক্ষীরোদার্ণব সম্ভবম্।
নমামি শশিনং ভক্ত্যা শম্ভোর্মুকুট ভূষণম।।
ধরণীগর্ভসম্ভুতং বিদ্যুৎপুঞ্জসমপ্রভম।
কুমারং শক্তিহস্তষ্ণ লোহিতাঙ্গং নমাম্যহম।।
প্রিয়ঙ্গুকলিকাশ্যামং রূপেণাপ্রতিমং বুধম্।
সৌম্যং সর্বগুণোপেতং নমামি শশিনঃ সুতম্।।
দেবতানামৃষীণাঞ্চ গুরুং কনকসন্নিভম্।
বন্দ্যভূতং ত্রিলোকেশং তং নমামি বৃহস্পতিম্।।
হিমকুন্দমৃণালাভং দৈত্যানাং পরমং গুরুম্।
সর্বশাস্ত্র প্রবক্তারং ভার্গবং প্রণমাম্যহম্।।
নীলাঞ্জনচয়প্রখ্যং রবিসুনুং মহাগ্রহম্।
ছায়ায়া গর্ভসম্ভুতং বন্দে ভক্ত্যা শনৈশ্চরম্।।
অর্দ্ধকায়ং মহাঘোরং চন্দ্রাদিত্যবিমর্দ্দকম্।
সিংহিকায়াঃ সূতং রৌদ্রং ত্বং রাহুং প্রণমাম্যহম্।।
পলালধুমসঙ্কাশং তারাগ্রহবিমর্দ্দকম্।
রৌদ্রং রুদ্রাত্মকং ক্রুরং তং কেতুং প্রণমাম্যহম্।।
নবগ্রহের গায়ত্রী মন্ত্র :-
(১) রবি (সূর্য) –
“ওঁ ভাস্করায় বিদ্মহে মহাতেজায় ধীমহিঃ তন্নঃ সূর্যঃ প্রচোদয়াৎ।”
(২) সোম (চন্দ্র) গ্রহ –
“ওঁ ক্ষীরপুত্রায় বিদ্মহে অমৃতত্বায় ধীমহিঃ তন্নঃ চন্দ্রঃ প্রচোদয়াৎ।”
(৩) মঙ্গল গ্রহ –
“ওঁ অঙ্গরকায় বিদ্মহে শক্তিহস্তায় ধীমহিঃ তন্নঃ ভৌমঃ প্রচোদয়াৎ।”
(৪) বুধ গ্রহ –
“ওঁ সৌম্যরূপায় বিদ্মহে বাণেশায় ধীমহিঃ তন্নঃ বুধঃ প্রচোদয়াৎ।”
(৫) বৃহস্পতি গ্রহ –
“ওঁ আঙ্গিরসায় বিদ্মহে দণ্ডায়ুধায় ধীমহিঃ তন্নঃ জীবঃ প্রচোদয়াৎ।”
(৬) শুক্র গ্রহ –
“ওঁ ভৃগুসুতায় বিদ্মহে দিব্যদেহায় ধীমহিঃ তন্নঃ শুত্রঃ প্রচোদয়াৎ।”
(৭) শনি গ্রহ –
“ওঁ সূর্যপুত্রায় বিদ্মহে মৃত্যুরূপায় ধীমহিঃ তন্নঃ সৌরিঃ প্রচোদয়াৎ।”
(৮) রাহু গ্রহ-
“ওঁ শিরোরূপায় বিদ্মহে অমৃতেশায় ধীমহিঃ তন্নঃ রাহুঃ প্রচোদয়াৎ।”
(৯) কেতু গ্রহ –
“ওঁ গদাহস্তায় বিদ্মহে অমৃতেশায় ধীমহিঃ তন্নঃ কেতুঃ প্রচোদয়াৎ।”
নবগ্রহ বীজ মন্ত্র:-
সূর্য মন্ত্র:-
“ওঁ হ্রীং হ্রীং সূর্য্যায়ঃ।”
(জপ সংখ্যা ৬০০০ বার)
দেবতা- মাতঙ্গী।
ধূপ- গুগুল।
বার- রবিবার।
প্রশস্ত- সকাল ১২ টা পর্যন্ত।
চন্দ্র মন্ত্র:-
“ওঁ ঐং ক্লীং সোমায়ঃ।”
(জপ সংখ্যা ১৫০০০ বার)
দেবতা- কমলা।
ধূপ- সরলকাষ্ঠ।
বার- সোমবার।
প্রশস্ত- সন্ধা ৬-৯ পর্যন্ত।
মঙ্গল মন্ত্র:-
“ওঁ হুং শ্রীং মঙ্গলায়ঃ।”
(জপ সংখ্যা-৮০০০ বার)
দেবতা- বগলামুখী।
ধূপ- দেবদারু।
বার- মঙ্গলবার।
প্রশস্ত- সকাল ১২ টা পর্যন্ত ।
বুধ মন্ত্র:-
“ওঁ ঐং স্ত্রীং শ্রীং বুধায়ঃ।”
(জপ সংখ্যা-১০০০০ বার)
দেবতা- ত্রিপুরাসুন্দরী।
ধূপ- সঘৃত দেবদারু।
বার- বুধবার।
প্রশস্ত- বেলা ১২টা পর্যন্ত।
বৃহস্পতি মন্ত্র:-
“ওঁ হ্রীং ক্লীং হুং বৃহস্পতয়ে।”
(জপ সংখ্যা-১৯০০০ বার)
দেবতা- তারা।
ধূপ- দশাঙ্গ।
বার- বৃহস্পতিবার।
প্রশস্ত- বেলা ১২ পর্যন্ত।
শুক্র মন্ত্র:-
“ওঁ হ্রীং শুক্রায়ঃ।”
(জপ সংখ্যা ২১০০০ বার)
দেবতা- ইন্দ্র।
ধূপ- গুগুল।
বার- শুক্রবার।
প্রশস্ত- সন্ধ্যাবেলা।
শণি মন্ত্র:-
“ওঁ ঐং হ্রীং শ্রীং শনৈশ্চরায়ঃ।”
(জপ সংখ্যা ১০০০০ বার)
দেবতা- দক্ষিনাকালী।
ধূপ- কৃষ্ণাগুরু।
বার- শনিবার।
প্রশস্ত- সন্ধ্যাবেলা।
রাহু মন্ত্র:-
“ওঁ ঐং হ্রীং রাহবে।”
(জপ সংখ্যা ১২০০০ বার)
দেবতা- ছিন্নমস্তা।
ধূপ- দারুচিনি।
বার- শনি/মঙ্গল বার।
প্রশস্ত- সন্ধ্যাবেলা।
কেতু মন্ত্র:-
“ওঁ হ্রীং ঐং কেতবে।”
(জপ সংখ্যা ২২০০০ বার)
দেবতা- ধূমাবতী।
ধূপ- মধূযুক্ত দারুচিনি।
বার- শনি/মঙ্গল বার।
প্রশস্ত- সন্ধ্যাবেলা।
নবগ্রহ প্রণাম মন্ত্র, নবগ্রহ স্তব, নবগ্রহ স্তোত্রম্ , নবগ্রহের গায়ত্রী মন্ত্র, নবগ্রহ বীজ মন্ত্র, নবগ্রহ কবচ সমাপ্ত।