শাশ্বতী চ্যাটার্জি:: এই বিশাল মহাবিশ্ব অনন্ত ব্রহ্মের প্রকাশ। পরমাত্মা জীবাত্মা রূপে নিজেকে এক থেকে বহু করেছে। এমনই বহুর একটি অংশ স্বামী বিবেকানন্দ।
তিনি বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের মধ্য দিয়েই বেদান্তকে ব্যাখ্যা করেছেন।তিনি যুক্তিবাদী ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মধ্য দিয়েই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে অভ্যস্ত।এমনি যুক্তিবাদী মানুষের জীবনে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে, যার ব্যাখ্যা লৌকিক যুক্তির সীমার বাইরে। এমন ঘটনাকেই আমরা “অলৌকিক” বলি।
স্বামীজির জীবনে এমন কিছু অলৌকিক ঘটনার কথা আমরা এখানে উল্লেখ করবো।
শিকাগো বক্তৃতার শেষে স্বামীজি আমেরিকার বিভিন্ন প্রান্তে বক্তৃতা করে চলেছেন। আমেরিকায় তাঁর শত্রু সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। আসলে ব্রাহ্ম সমাজ ও থিওসফিকাল সোসাইটি বিশ্ব ধর্ম সম্মেলনে স্বামীজির উপস্থিতি মেনে নিতে পারেননি। ফলে তাঁরা অনেকেই স্বামীজির প্রতি ঈর্ষা কাতর।
এমন কি সেই সময় স্বামীজিকে হত্যার পরিকল্পনার কথাও শোনা যায়।যদিও স্বামীজি তখন ছিলেন সম্পূর্ণ স্থিতধী।তাঁর ধারণা তিনি দেব-রক্ষিত। এই রকম সময়ে একটি ঘটনা স্বামী বিজ্ঞানানন্দজী বলেছেন –“ডেট্রয়েটে এক নৈশভোজে স্বামীজি কফির পেয়ালা চুমুক দিতে যাইবেন, এমব সময় দেখিলেন, রামকৃষ্ণ তাহার পার্শ্বে দাঁড়াইয়া বলিতেছেন, “খাসনি ও বিষ”।”- (যুগনায়ক বিবেকানন্দ – ২য় খন্ড-১১২ পৃষ্ঠা) এর পরে অবশ্য তিনি কফি পান করা থেকে বিরত ছিলেন।এই ঘটনার পিছনে তাঁর তৎকালীন ভীত সন্ত্রস্ত মানসিকাবস্থাও দায়ী হতে পারে!!
কিন্তু স্বামীজির জীবনে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে, যা যুক্তিবাদ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। আমেরিকা থেকে ফিরে তাঁর অত্যন্ত শরীর খারাপ হলে তিনি চিকিৎসকের পরামর্শে দার্জিলিং যান। স্বামীজির জীবনিকার এখানে তিনটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন।
প্রথম — একদিন সকালে কিছু খুদে সঙ্গী নিয়ে স্বামীজি প্রাতঃভ্রমণে বেড়িয়েছেন। পথে দেখেন একজন ভুটিয়া মহিলা পিঠে অনেক বোঝা নিয়ে খুব কষ্ট করে হেঁটে চলেছেন।হঠাৎ তিনি রাস্তায় পড়ে যান। তখন স্বামীজি খুদে সঙ্গীদের বলেন, তাঁর পাঁজরে খুব ব্যথা হচ্ছে।পরে ছোটো সঙ্গীদের নিজের পাঁজর দেখিয়ে বলেন -“এইখানে। দেখিসনি ওই স্ত্রীলোকটির কেমন লেগেছে।”
এই ঘটনার বিশ্লেষণ করতে গিয়ে গম্ভীরানন্দজি লিখেছেন – “আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতাশূন্য বালকগণ ইহার তাৎপর্য তখন বুঝিতে পারে নাই।বুঝিয়াছিল অনেক পরে।একজনের ব্যথা সত্যি অপর এক জনের দৈহিক যন্ত্রণার কারণ হইতে পারে –ইহা সাধারণের বোধগম্য নহে।
তবে শ্রী রামকৃষ্ণের জীবনী পাঠে অবগত হওয়া যায় যে,দক্ষিণেশ্বরে বিবাদমান মাঝিদের একজন অপরজনকে আঘাত করিলে, সে ব্যথা রামকৃষ্ণের দেহে অনুভূত হইয়াছিল।”(ঐ- ৩৫৩ পৃষ্ঠা)
দ্বিতীয় – দার্জিলিংয়ের আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করা দরকার। স্বামীজির এক শিষ্য মতিলাল মুখোপাধ্যায় প্রবল জ্বরে আক্রান্ত হয়ে প্রলাপ বকছেন। স্বামীজি খবর পেয়ে তার ঘরে প্রবেশ করে তার কপালে হাত রাখতেই জ্বর কমতে শুরু করে, আর অল্প সময়ের মধ্যেই জ্বর সম্পূর্ণ চলে যায়।
তৃতীয় ঘটনাটি বিবেকানন্দের গবেষকদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা জানি খেতড়ি রাজ অজিত সিং এর সঙ্গে স্বামীজির অত্যন্ত সুসম্পর্ক ছিল।
খেতড়ি রাজ মার্চ মাসে ইংল্যান্ডে যাবার আগে কলকাতায় আসেন স্বামীজির সঙ্গে দেখা করতে। তাঁর ইচ্ছে ছিল, স্বামীজিকে ইংল্যান্ডে নিয়ে যাবেন।কিন্তু শারীরিক কারণে স্বামীজির পক্ষে তা সম্ভব হয়নি। ১৮ মার্চ, ১৮৯৭ রাজা অজিত সিং কলকাতা পৌঁছান। স্বামীজি তাঁকে তার যোগে জানান যে তিনি ২১ মার্চ, ১৮৯৭ কলকাতা পৌঁছাবেন। যথা সময়ে স্বামীজি কলকাতা পৌঁছন। রাজা অজিত সিং এর কলকাতার বাড়িতে স্বামীজি গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করেন ও পরের দিন অর্থাৎ ২২ মার্চ,১৮৯৭ স্বামীজি মঠে যান। এই ঘটনার স্বাক্ষী ছিলেন অনেকেই। কিন্তু গবেষকেরা গবেষণা করে দেখেন স্বামীজি অন্তত ১৯ মার্চ থেকে ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত দার্জিলিং এ ছিলেন।তাহলে এটা কি করে সম্ভব ?
এখানে অন্য ধরনের একটি ঘটনা উল্লেখ করতে চাই। স্বামীজি হিমালয় ভ্রমণ করাকালীন এক সন্ধ্যায় মাদলের বাজনা শুনতে পেলেন।স্বামীজি সেই বাজনার স্থানে গিয়ে জানতে পারলেন, জনৈক মানুষকে দেবতা ভর করেছে। গ্রামের লোকদের ধারনা তার মধ্যে ভূত ঢুকেছে। ভূত তাড়ানোর জন্য এক ব্যক্তি তার উপর নির্মম অত্যাচার করছে। একটা কুঠার আগুনে তপ্ত করে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছ্যাকা দিচ্ছে। গ্রামের মোড়লের অনুরোধে স্বামীজি মানুষটির কাছে গিয়ে প্রথমে কুঠারটিতে যেই হাত দেয়, হাত যায় পুড়ে।”
ওই যন্ত্রণা লইয়া লোকটির মাথায় হাত রাখিয়া তিনি খানিকক্ষণ জপ করিলেন। আশ্চর্যের বিষয় ঐরূপ করার দশ-বারো মিনিটের মধ্যে লোকটি সুস্থ হইয়া গেল।” ( ঐ ৩ খন্ড – ২৬ পৃষ্ঠা)। এই ধরনের ঘটনার ব্যাখ্যা সাধারণ বুদ্ধির বাইরে।
অন্যত্র একটি ঘটনায় দেখা যায় স্বামীজির স্পর্শে একজন অসুস্থ মানুষ সুস্থ হয়ে যান। ১৮৯৪ সালে আমেরিকার ঘটনা। আমেরিকার একজন মহিলা বিবেকানন্দের এক শিষ্যকে বিবেকানন্দ সম্পর্কে চিঠি লিখে জানান -“বন্ধুটির বাটিতে বসবাসকালে আমি জ্বরে পড়িলাম। সে বিষম জ্বর। আমায় যন্ত্রনায় ছটফট করিতে দেখিয়া স্বামীজি জিজ্ঞাসা করলেন, ”তোমার অসুখ সারিয়ে দেব?” আমি বলিলাম, “তা যদি পারেন তো বড় সুখের বিষয় হয়।” এই কথা শুনিয়া তিনি আমার সম্মুখে আসিয়া বসিলেন এবং আমার হাত দুখানি তাহার হাতের তালুর উপর রাখিতে বলিলেন। আমি ঐরূপ করিলে তিনি চক্ষু মুদিত করিয়া নিশ্চলভাবে বসিয়া রহিলেন।ক্রমে তাহার হাত দুইটি শীতল হইয়া আসিল এবং মনে হইল তিনি যেন কাঠের মতো শক্ত হইয়া গিয়াছে। – – – সঙ্গে সঙ্গে দেখিয়া আশ্চর্য হইলাম যে, আমার জ্বর একেবারে সরিয়ে গিয়াছে।”
স্বামী গম্ভীরানন্দজি বলেছেন, স্বামীজি বিশ্বাস করতেন যে গভীর চিন্তার মাধ্যমে রোগ সরানো যায়। স্বামীজির ভাই মহেন্দ্রনাথ দত্ত “লন্ডনে বিবেকানন্দ” গ্রন্থে এমন কিছু ঘটনার উল্লেখ করেছেন।
স্বামীজি এক নাগাড়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বক্তৃতা দিতে পারতেন। কিন্তু এতো শক্তি ও এতো কথা তিনি পেতেন কোথা থেকে?ভগিনী নিবেদিতা “স্বামীজিকে যেরূপ দেখেছি” গ্রন্থে লিখেছেন “তিনি বলিয়াছিলেন, রাত্রে তাহার নিজের ঘরে এক অশরীরী স্বর পরদিবসের বক্তৃতার কথাগুলি তাহাকে শুনাইয়া জোরে জোরে বলিতে থাকিত এবং পর দিন বক্তৃতামঞ্চে দাঁড়াইয়া তিনি দেখতেন ওই কথাগুলি পুনরাবৃত্তি করিয়া চলিয়াছে। কখনো কখনো শুনিতেন, দুইটি স্বর পরস্পর আলোচনা করিতেছে। কখনও মনে হইত, কোন সুদূর হইতে যেন, দীর্ঘ বীথিকাবলম্বনে তাহার কর্ণে আসিয়া পৌঁছাইতেছে।হয়তো পরে ক্রমে নিকটে আসিতে আসিতে উহা উচ্চারণে পরিণত হইত।”
উল্লিখিত ঘটনাগুলোর হয়তো কিছু লৌকিক ব্যাখ্যা দেওয়া যায়। কিন্তু আর পাঁচ জন সাধারণ মানুষের মতো স্বামীজি সম্পর্কে সেই লৌকিক ব্যাখ্যায় আমরা না হয় নাই গেলাম।আসলে মহাপুরুষদের জীবনে এমন কিছু ঘটনা কখনো কখনো ঘটে,যার কোনো লৌকিক কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না।