খবরে আমরাঃ কামরূপ-কামাখ্যা। শক্তিপীঠ হিসাবে পরিচিত এি কামাখ্যা। অম্বুবাচীর মূল প্রাণকেন্দ্র। তন্ত্র মতে যাঁরা সাধনা করেন তাঁদের মূল পীঠস্থান হিসাবে চিহ্নিত এই কামাখ্য। আজ পড়ব সেই কামাখ্যার কথা।
অসমের রাজধানী গুয়াহাটির পশ্চিমাংশে অবস্থিত নীলাচল পাহাড়ে রয়েছে কামাখ্যা মন্দির। এটি হিন্দু তথা তান্ত্রিকদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র তীর্থস্থল। এটি একটি প্রাচীন হিন্দু মন্দির। দেবী মহামায়া এই মন্দিরে কামাখ্যারূপে বিরাজমান। কামাখ্যা তীর্থক্ষেত্র একটি শক্তিপীঠ ও তন্ত্র সাধনার ক্ষেত্র। এটি ৫১ শক্তিপীঠের অন্যতম। কথিত আছে, এখানে সতীর দেহত্যাগের পর বিষ্ণুর সুদর্শন চক্রে যোনি ছিন্ন হয়ে পড়েছিল।
বারাণসীর বৈদিক ঋষি বাৎস্যায়ন খ্রিস্টিয় প্রথম শতাব্দীতে নেপালের রাজার দ্বারস্থ হয়ে উপজাতীয় গোষ্ঠীগুলিকে হিন্দুধর্মে ধর্মান্তরিত ও তাদের নরবলি প্রথার গ্রহণযোগ্য বিকল্প চালু করার জন্য অনুরোধ করেন।
বাৎস্যায়নের মতে, পূর্ব হিমালয়ের গারো পাহাড়ে তারা দেবীর তান্ত্রিক পূজা প্রচলিত ছিল। সেখানে আদিবাসীরা দেবীর যোনিকে ‘কামাকি’ নামে পূজা করত। ব্রাহ্মণ্যযুগে কালিকাপুরাণে সব দেবীকেই মহাশক্তির অংশ বলা হয়েছে। সেই হিসেবে, কামাক্ষ্যাও মহাশক্তির অংশ হিসেবে পূজিত হন।
এই কামাখ্যা মন্দিরকে ঘিরে রয়েছে দারুণ সব কাহিনি। সেসব শুনলে অবাক হয়ে যাবেন।
শক্তিপীঠ কামাখ্যা
কামাখ্যা ৫১ শক্তিপীঠের অন্যতম। হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী, কামাখ্যা মন্দিরে দেবী সতীর গর্ভ এবং যোনি পড়েছিল। সেকারণেই দেবী কামাখ্যাকে ঊর্বরতার দেবী বা “রক্তক্ষরণকারী দেবী” বলা হয়। এই মন্দির চত্বরে দশ মহাবিদ্যার মন্দির রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে মহাকালী, তারা, ষোড়শী বা ললিতাম্বা ত্রিপুরেসুন্দরী, ভুবনেশ্বরী বা জগদ্ধাত্রী,কামাখ্যা, শৈলকন্যা, ব্রক্ষচারিণী বা তপস্যারিণী, মঙ্গলচন্ডী, কুষ্মাণ্ডা, মহাগৌরী, চামুণ্ডা,কৌষিকী, দাক্ষায়ণী-সতী, চন্দ্রঘণ্টা, স্বন্দমাতা, কালরাত্রি, কাত্যায়ণী, সিদ্ধিদাত্রী, শাকম্ভরী, হৈমবতী, শীতলা,সংকটনাশিণী,বনচণ্ডী, দেবী দুর্গা, মহাভৈরবী, ধূমাবতী, ছিন্নমস্তা, বগলামুখী, মাতঙ্গী এবং দেবী কমলা – এই ত্রিশ দেবীর মন্দির। এর মধ্যে ত্রিপুরেসুন্দরী, মাতঙ্গী এবং কমলা প্রধান মন্দিরে পূজিত হন। অন্যান্য দেবীদের জন্য পৃথক মন্দির আছে। হিন্দুদের, বিশেষত তন্ত্রসাধকদের কাছে এই মন্দির একটি পবিত্র তীর্থ।
শক্তিপীঠের গল্প
হিন্দু পুরাণ অনুসারে, রাজা দক্ষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে মহাদেবকে বিয়ে করেছিলেন তাঁর কন্যা সতী। মহাদেবের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য দক্ষ রাজা বৃহস্পতি নামে এক যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। যজ্ঞে সতী কিংবা মহাদেব কাউকেই আমন্ত্রণ জানাননি দক্ষ। মহাদেবের অনিচ্ছা সত্ত্বেও সতী বাবার আয়োজিত যজ্ঞানুষ্ঠানে যান। সেখানে দক্ষ মহাদেবকে অপমান করেন। স্বামীর অপমান সহ্য করতে না পেরে সতী দেহত্যাগ করেন। শোকাহত মহাদেব দক্ষর যজ্ঞ ভণ্ডুল করেন এবং দেবী সতীর মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রলয় নৃত্য শুরু করেন। তাঁর তাণ্ডব বন্ধ করতে অন্যান্য দেবতাদের অনুরোধে বিষ্ণুদেব তাঁর সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর মৃতদেহ ছেদন করেন। এতে সতীর দেহখণ্ডসমূহ ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন জায়গায় পড়ে এবং পবিত্র পীঠস্থান শক্তিপীঠ বা সতীপীঠ নামে পরিচিতি। কামাখ্যা সেই শক্তিপীঠের অন্যতম।
অম্বুবাচীর মেলা
দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং বিখ্যাত অম্বুবাচী মেলার আয়োজন করা হয় অসমের কামাখ্যা মন্দির সংলগ্ন এলাকায়। হিন্দু ধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ী আষাঢ় মাসে মৃগ শিরা নক্ষত্রের তিনটি পদ শেষ হলে পৃথিবী বা ধরিত্রী মা ঋতুময়ী হয়। এই সময়টিতে অম্বুবাচী পালন করা হয়। আর এই উপলক্ষে বিশাল এক মেলার আয়োজন করা হয় সেখানে। অম্বুবাচীর দিন থেকে মোট তিনদিন দেবী কামাক্ষ্যার মন্দির বন্ধ থাকে। সেই তিনদিন কোনও মাঙ্গলিক কাজ করা যায় না। দেবী দর্শনও নিষিদ্ধ থাকে। চতুর্থ দিন দেবীর স্নান এবং পূজা সম্পূর্ণ হওয়ার পর মন্দিরে দেবী মূর্তি দর্শনের অনুমতি দেওয়া হয়।
সেই উপলক্ষে সেখানে উপস্থিত হন লক্ষ লক্ষ ভক্ত। অবাক করা এই ঘটনার সাক্ষী হতে ভিড় জমান দেশি বিদেশি পর্যটকরা। কামাক্ষ্যা মন্দিরের চারদিকে চলে নাম সংকীর্তন। অম্বুবাচীর শেষ দিন ভক্তদের রক্তবস্ত্র উপহার দেওয়া হয়। দেবী পীঠের সেই রক্তবস্ত্র ধারণ করলে মনোকামনা পূর্ণ হয় বলে বিশ্বাস করেন ভক্তরা। অম্বুবাচীর মেলা আন্তর্জাতিক স্তরে বিখ্যাত। মেলাকে কেন্দ্র করে যে বিশাল মেলার আয়োজন করা হয় সেটিও দেখবার মতো।
আধুনিক নারীবাদের প্রাচীনরূপ
আধুনিককালে নারীবাদ নিয়ে গোটা বিশ্ব সোচ্চারকামাখ্যা মন্দিরে অথচ সেই প্রাচীন যুগ থেকেই আমাদের দেশে নারীকে শক্তি হিসেবে পূজা করা হয়। কামাখ্যা মন্দির তার জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ। কালিকা পুরাণ এবং যোগিনী তন্ত্র অনুযায়ী প্রতিটি নারীই শক্তির প্রতীক। এটিই শক্তিবাদের প্রধান কথা।
মন্দিরের অপূর্ব স্থাপত্য
কামাখ্যা মন্দিরে চারটি কক্ষ আছে। গর্ভগৃহ এবং তিনটি মণ্ডপ। মণ্ডপগুলির নাম চলন্ত, পঞ্চরত্ন এবং নাটমন্দির। গর্ভগৃহটি পঞ্চরথ স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত। অন্যগুলির স্থাপত্য তেজপুরের সূর্যমন্দিরের সমতুল্য। এগুলিতে খাজুরাহো বা অন্যান্য মধ্যভারতীয় মন্দিরের আদলে নির্মিত খোদাইচিত্র দেখা যায়। মন্দিরের চূড়াগুলি মৌচাকের মতো দেখতে। নিম্ন অসমের বহু মন্দিরে এই ধরনের চূড়া দেখা যায়। গর্ভগৃহটি আসলে ভূগর্ভস্থ একটি গুহা।
এখানে কোনও মূর্তি নেই। শুধু একটি পাথরের সরু গর্ত দেখা যায়। গর্ভগৃহটি ছোটো এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন। সরু খাড়াই সিঁড়ি পেরিয়ে এখানে পৌঁছাতে হয়। ভিতরে ঢালু পাথরের একটি খণ্ড আছে। সেটি যোনির আকৃতি বিশিষ্ট। এটিতে প্রায় দশ ইঞ্চি গভীর একটি গর্ত দেখা যায়। একটি ভূগর্ভস্থ প্রস্রবনের জল বেরিয়ে এই গর্তটি সবসময় ভর্তি রাখে। এই গর্তটিই দেবী কামাখ্যা নামে পূজিত এবং দেবীর পীঠ হিসেবে প্রসিদ্ধ। কামাখ্যা মন্দির চত্বরের অন্যান্য মন্দিরগুলিতেই একই রকম যোনি-আকৃতিবিশিষ্ট পাথর দেখা যায়, যা ভূগর্ভস্থ প্রস্রবনের জল দ্বারা পূর্ণ থাকে।