শিবানী ভট্টাচার্য বন্দ্যোপাধ্যায়
তিনি ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই গুরুর ছায়া-প্রকাশ। সম্পর্কের নিরিখে ‘The Levitating Saint’ – ভাদুড়ী মহাশয় অর্থাৎ মহর্ষি নগেন্দ্রনাথ ভাদুড়ীর ভ্রাতুষ্পুত্র এবং ত্যাগী শিষ্য।
মহর্ষি নগেন্দ্রনাথ তাঁর প্রতিক্ষণের ছায়া সঙ্গী এই ভ্রাতুষ্পুত্রকে নিজের ভাবসন্তানের মর্যাদা প্রদান করেন। মহর্ষি নগেন্দ্রনাথ পদ্মাসনে বসে তাঁর পার্থিব দেহ ত্যাগ করলে তাঁর প্রবর্তিত যোগ-ভক্তি মার্গের আধ্যাত্মিক পরম্পরার এবং মহর্ষিদেবের শেষ জীবনের সাধন ভূমি – শ্রীশ্রীনগেন্দ্র মঠের যাবতীয় দায়িত্ব পালন করেন ধ্যানপ্রকাশ ব্রহ্মচারী। তিনিই ছিলেন শ্রীশ্রীনগেন্দ্র মঠের প্রথম মোহান্ত।
ধ্যানপ্রকাশ ব্রহ্মচারীর পূর্ব জীবনের নাম ছিল ননীলাল ভাদুড়ী। তিনি ছিলেন ভাদুড়ী মহাশয় অর্থাৎ মহর্ষি নগেন্দ্রনাথের মেজদার ছোট ছেলে। ইনি মহর্ষিদেবের আগ্রহে মহর্ষিদেব প্রতিষ্ঠিত পেট্রিয়টিক ইনস্টিটিউশনে পড়াশোনা করেন। পরে এন্ট্রান্স পাশ করে রিপন কলেজে এফ.এ পড়তে থাকেন।
অল্প বয়স থেকেই বৈষয়িক বিষয়ে এক আশ্চর্য রকমের উদাসীন ছিলেন ইনি। সেই কারণেই মাত্র তিন দিন তিনি Mackinnon Mackenjie অফিসে চাকরি করেন। তাঁর বিবাহ দেওয়ার চেষ্টা হলে তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। পরবর্তীতে মহর্ষি নগেন্দ্রনাথকে গুরু পদে বরণ করে তিনি সাধন জীবন বেছে নেন।
মহর্ষি নগেন্দ্রনাথ কুম্ভ মেলায় যোগদানের জন্য এলাহাবাদে গেলে ননীলাল ভাদুড়ী তাঁর সঙ্গী হন। নগেন্দ্রনাথের কাছে ইতিমধ্যেই তাঁর ব্রহ্মচর্য দীক্ষা হয়েছিল। কিন্তু তাঁর মনে সন্ন্যাস গ্রহণের তীব্র ইচ্ছা ছিল। এই সময় নগেন্দ্রনাথ নিজেও সন্ন্যাস গ্রহণে আগ্রহী হন। ১৮৮১-৮২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে নগেন্দ্রনাথ কোনও এক দণ্ডী সন্ন্যাসী যোগী পুরুষকে গুরু হিসেবে গ্রহণ করেন। সন্ন্যাস দীক্ষার পর তিনি হিমালয়ে গিয়ে কঠোর তপস্যা করার ইচ্ছাও গুরুর কাছে ব্যক্ত করেন। কিন্তু গুরুদেব তাঁকে সনাতন ধর্ম প্রচারের নির্দেশ প্রদান করেন। তিনিই নির্দিষ্ট করে দেন মহর্ষি নগেন্দ্রনাথের কর্মভূমি। সেই নির্দেশ অনুসারে কলকাতায় চলে আসেন মহর্ষি নগেন্দ্রনাথ। ননীলাল ভাদুড়ীও এই কাজে ঐ সন্ন্যাসীর নির্দেশে মহর্ষিদেবের সঙ্গী হন।
মহর্ষিদেবের সাধনা যাতে কোনও অবস্থাতেই বিঘ্নিত না হয় সেজন্য সদা সতর্ক থাকতেন তাঁর এক শিষ্য। পরমহংস যোগানন্দের আত্মজীবনী – ‘Autobiography of a Yogi’-তে এর বিবরণ আছে। এই শিষ্য যে ধ্যানপ্রকাশ ব্রহ্মচারী তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
ধ্যানপ্রকাশ ব্রহ্মচারী ছিলেন নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারী এবং হঠ যোগী। যোগী হলেও তিনি শ্রীমদ্ভাগবত পাঠ করতেন। সূর্যোদয়ের পূর্বে শয্যা ত্যাগ করতেন। আসনে থাকতেন তিন ঘণ্টা। কখনও বা তারও বেশি।
১৮৮১ সালে ভাদুড়ী মহাশয় – মহর্ষি নগেন্দ্রনাথ আধ্যাত্মিক পত্রিকা – সত্যপ্রদীপ পত্রিকা প্রকাশ করেন। এখানেই ধ্যানপ্রকাশ ব্রহ্মচারী মহারাজের সম্পাদনায় ১৩৪৫ সালের গুরু পূর্ণিমা থেকে ১৩৫১ সালের আশ্বিন পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে ‘শ্রীশ্রীনগেন্দ্র – উপদেশামৃত’ প্রকাশিত হয়।
ধ্যানপ্রকাশ ব্রহ্মচারী সংকলিত গ্রন্থ – মহর্ষি নগেন্দ্রনাথ নির্দেশিত পন্থা নির্ভর ‘সচিত্র ব্রহ্মচর্য্য ও শরীর পালন’। তৎকালীন বসুমতী-তে এই গ্রন্থটির বহুল প্রচার কামনা করে অভিমত প্রকাশ করা হয়।
ধ্যানপ্রকাশ ব্রহ্মচারী বহন করেছিলেন মহর্ষি নগেন্দ্রনাথের সাধনার উত্তরাধিকার। মহর্ষি নগেন্দ্রনাথের মতোই শোনা যায় তিনিও লঘিমা সিদ্ধ ছিলেন। তাই তিনিও শূন্যে ভাসতে পারতেন। কিন্তু তাঁর সাধনা ছিল গুপ্ত। তাই তার প্রকাশ দেখা যেত না। ধ্যানপ্রকাশ ব্রহ্মচারীর শিষ্য ভক্তিপ্রকাশ ব্রহ্মচারীর লেখা থেকে ধ্যানপ্রকাশ ব্রহ্মচারীর অলৌকিক ক্ষমতার কিছু কাহিনি জানা যায়। ভক্তিপ্রকাশ ব্রহ্মচারী লিখিত ‘শ্রীগুরুচরণতলে’ গ্রন্থটি থেকেই জানা যায় – ধ্যানপ্রকাশ ব্রহ্মচারীর মুখে তাঁর সাধনার জ্যোতি বিকীর্ণ হতো। শোনা যায় – মহর্ষি নগেন্দ্রনাথ এবং প্রভু জগদ্বন্ধুসুন্দরের মতো তাঁর অঙ্গ থেকেও জ্যোতি প্রকাশিত হতো। ধ্যানে বসলে গভীরতম অবস্থায় তাঁর সেই জ্যোতি ছড়িয়ে যেতো। সেই জন্যই তিনি ধ্যানপ্রকাশ। শ্রীশ্রীনগেন্দ্র মঠের আচার্য প্রয়াত রঘুপতি মুখোপাধ্যায় এ কথা প্রায়ই বলতেন।
মহর্ষি নগেন্দ্রনাথের এই ত্যাগী শিষ্য ধ্যানপ্রকাশ ব্রহ্মচারী ছিলেন পুরী গোবর্ধন মঠের অধীন ব্রহ্মচারী। সেই ঐতিহ্য বহন করে তিনি ব্রহ্মচর্য দীক্ষা প্রদান করেন শ্রীশ্রীনগেন্দ্র মঠের দ্বিতীয় মোহন্ত ভক্তিপ্রকাশ ব্রহ্মচারীকে।
অধিকাংশ সময় যোগ সাধনায় নিমগ্ন থাকলেও ধ্যানপ্রকাশ ব্রহ্মচারীও যে তাঁর গুরু মহর্ষি নগেন্দ্রনাথের শাস্ত্র জ্ঞানের উত্তরাধিকার বহন করতেন তা জানা যায় ভক্তিপ্রকাশ ব্রহ্মচারী লিখিত ‘শ্রীগুরুচরণতলে’ গ্রন্থটি থেকে।
১৯৫৭-র ৩০ মে তিনি যোগবলে ব্রহ্মলীন হন। এই পরিণতির কারণও মহর্ষি নগেন্দ্রনাথের মতোই অন্যের রোগ আকর্ষণ। আসলে, তিনি তাঁর শ্রীদেহে প্রতিমুহূর্তে বহন করেছেন মহর্ষি নগেন্দ্রনাথের ভাবমূর্তি। তারই প্রতীক হিসেবে ধারণ করেছেন রুদ্রাক্ষমালা। শ্রীচৈতন্য ভাগবতে আছে :
” রুদ্রাক্ষ বিরাল অক্ষ সুবর্ণ রজ্জুতে।
বান্ধিয়া ধরিয়া কণ্ঠে মহেশের প্রীতে।।”
-যোগমার্গের সাধক হলেও মহর্ষি নগেন্দ্রনাথ নির্দেশ করে গিয়েছেন ভক্তি মার্গ – হরি ভক্তি – হরিনাম কীর্তন। ভক্তদের চোখে মহর্ষি নগেন্দ্রনাথ বহিরঙ্গে শিব, অন্তরঙ্গে বিষ্ণু। ধ্যানপ্রকাশ ব্রহ্মচারী শুধু সেই নির্দেশিত পন্থা গ্রহণ করেননি, ধারণ করেছেন বহিরঙ্গে গুরু প্রতীকও। কারণ মহর্ষি নগেন্দ্রনাথ যে বহিরঙ্গে স্বয়ং শিব। তাই তিনি শুধু ভক্তদের চোখে নয় – আক্ষরিক অর্থেই মহর্ষিদেব অর্থাৎ নগেন্দ্রনাথের ছায়া প্রকাশও।
তাঁর ভাবধারা বহন করে পরবর্তী মোহন্ত হন ভক্তিপ্রকাশ ব্রহ্মচারী। আজও সেই আধ্যাত্মিক ভাবধারা বহন করে চলছে কলকাতার রামমোহন রায় রোডের শ্রীশ্রীনগেন্দ্র মঠ এবং নগেন্দ্র মিশন।
লেখিকা সম্পর্কে মহর্ষি নগেন্দ্রনাথের প্রপৌত্রী।
ছবি সৌজন্যে : শ্রীশ্রীনগেন্দ্র মঠ এবং নগেন্দ্র মিশন