মৃত্যু সম্পর্কে যখন নচিকেতা যমরাজকে প্রশ্ন করেছিলেন যে, আমি জানতে চাই জীবনের পরপারে কী আছে? তখন তিনি বলেছিলেন, ‘নচিকেতা, তুমি আমার কাছে যা কিছু জানতে চাও, আমি সব তোমাকে বলব। কিন্তু সেই অদৃশ্যলোকে, মানুষ যেখানে গমন করে – সেই লোকের কথা তুমি আমার কাছে জানতে চেয়ো না।
তোমাকে আমি পৃথিবীর সমস্ত ঐশ্বর্য দান করে দিচ্ছি, যত ভোগের উপকরণ আছে, সব তোমাকে দিয়ে দিচ্ছি। অজস্র অশ্ব দিচ্ছি, সুন্দরী রমণী দিচ্ছি, প্রচুর অর্থ দিচ্ছি, রাজসিংহাসন দিচ্ছি – কিন্তু তুমি আমাকে মৃত্যু সম্বন্ধে, জীবনের ওপারে মৃত্যুর সেই অন্ধকার-লোকে কী আছে, সে সম্বন্ধে কোনও প্রশ্ন কোরো না।’
এই কথোপকথনের মধ্য দিয়ে যে সত্যটি আবিষ্কার করা গিয়েছিল, সেটি হচ্ছে – আমরা যে আত্মার বিশ্বাস করি, সেই আত্মার জন্মও নেই, মৃত্যুও নেই। একথা মুখে বলা খুবই সহজ, অভ্যাস করা খুব কঠিন। সেজন্য ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন যে, তোমরা মৃত্যু-সচেতন হও। কেন মৃত্যু-সচেতন হতে বলছেন তিনি? এইজন্যই বলেছেন যে মানুষ বড় জীবনকে আঁকড়ে থাকতে ভালোবাসে। যে যে অবস্থায় থাকুক না কেন, ধনী হোক, দরিদ্র হোক, পথের পাশে পড়ে থাকা কোনও ভিখারী হোক – সে কিন্তু চায় বাঁচতে।
কিন্তু বাঁচা শব্দটার অর্থ আমরা কেউই জানি না। বাঁচা মানে আমরা যেটুকু ব্যাখ্যা করি বা বুঝি, সেটুকু হচ্ছে একটা অভ্যাসের চাকায় আবর্তিত হওয়া। রোজ সকাল আসবে, রাত্রি আসবে – আবার সকাল আসবে, আবার রাত্রি আসবে – এবং আমরা একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাব। মৃত্যুর দিকে মানে কী? অস্তিত্ব থেকে অনস্তিত্বের দিকে এগিয়ে যাওয়া – অর্থাৎ আমি যে আমিটাকে আঁকড়ে ধরে আছি; এই আমির পরিচয় – আমি যে নাম বলি, আমার যে ঠিকানা বা জীবিকা বা পেশা ইত্যাদি যেমন বস্তু দিয়ে এই আমিটি গঠিত হয়েছে।
সেই আমিটি আমি হারিয়ে ফেলব একদিন। এবং সেটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় আতঙ্ক। আমার ছিল – এই ছিল, সেই ছিল, বাড়ি ছিল, গাড়ি ছিল, অমুক ছিল, তমুক ছিল। এই আমার, আমার – এই বস্তুগুলোকে ছেড়ে চলে যেতে আমাদের বড় বেদনা হয়। সেইজন্য ঠাকুর বলছেন এটি হচ্ছে বাপু তোমার কাঁচা আমি – যে আমি বলে যে এই পৃথিবীতে আমার যে সমস্ত বস্তু চিহ্নিত হয়ে আছে, সেগুলি আমার এবং এতে কারোর অধিকার নেই। ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ (Ramkrishna Paramhamsa) বলছেন, এটা তোমার কাঁচা আমি।
তার কারণ, এর কোনোটিই তোমার নয়। তুমি যে মুহূর্তে চোখ বুজবে – কোথায় তোমার বাড়ি, কোথায় তোমার গাড়ি, কোথায় তোমার ঘর? কোথায় তোমার স্ত্রী – পুত্র – পরিবার? কিছুই নেই। যদি জীবনের প্রথম স্তরেই আমরা এই ধারণাটি করে নিতে পারি যে এই পৃথিবীতে যা কিছু আমি আমার বলে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছি, সেগুলোর কোনোটিই আমি সঙ্গে নিয়ে যেতে পারব না; অতএব, এগুলোর সবই হচ্ছে অনিত্য বস্তু।(Spiritual)
অনিত্য বস্তু মানে কী? আমার অনস্তিত্বের সঙ্গে সঙ্গে যেগুলোর আর কোনও অস্তিত্ব থাকবে না। সেই বস্তুগুলোকে ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, অনিত্য বস্তু। আর কোন বস্তুটি নিত্য? যে বস্তুটি আমি চলে যাবার পর থাকবে, যে বস্তুটিতে গিয়ে আমি হাজির হব; সেই বস্তুটি নিত্য। তিনি কে? সেই নিত্যবস্তুটি কী? (Sanjib Chattopadhyay)
বলছেন, তিনি ঈশ্বর।
কেন ঈশ্বর? কেমন ঈশ্বর?
বললেন, তাঁকে তুমি রূপে কল্পনা করো। তাঁর অনেক রূপ আছে। তুমি যদি জ্ঞান দিয়ে তাঁকে ধরতে চাও, তাহলে তিনি জ্ঞানী। তিনি কখনও সাকার, কখনও নিরাকার। এবং এই ঈশ্বরকে তুমি যে আখ্যায়ই ভূষিত করো না কেন, তিনি ঠিক সেই রূপেই তোমার সামনে হাজির হবেন। তোমার বিশ্বাসে ঠিক সেই ভাবেই ধরা দেবেন।
এবং তুমি যদি নাস্তিকও হও, সেই নাস্তিককেও তিনি বলছেন ঘোরতর আস্তিক। তার কারণ, তিনি একটা জিনিসকে ফেলে দিতে চাইছেন – সেটা হচ্ছে আমি ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করি না। অতএব আমার সংগ্রাম তাঁর সঙ্গে।
(সংগৃহীত)