এককালে এ দেশের ভদ্রশ্রেণিই উচ্চশিক্ষা আর ভদ্রোচিত জীবিকার সুযোগ পেত। দারিদ্র্যের জন্য এবং ক্ষমতাবান আত্মীয়-বন্ধুর অভাবে ভদ্রেতর শ্রেণি এই সুযোগ পেত না। শিক্ষা ও জীবিকার ক্ষেত্রে এই বৈষম্য এখন ক্রমশ কমে আসছে, কালক্রমে একেবারে লোপ পাবার সম্ভাবনা আছে।
শিক্ষা আর প্রচারের ফলে জাতিগত, বর্ণগত ও বংশগত ভেদবুদ্ধি দূর হতে পারে, কিন্তু অপরিচ্ছন্নতা আর অমার্জিত আচরণের প্রতি বিদ্বেষ ত্যাগ করা দুঃসাধ্য। শুচিতার ধারণা সকলের সমান নয়। এ দেশের লোক আহারের পর আচমন করে, মলত্যাগের পর জলশৌচ করে, অতি দরিদ্রও প্রত্যহ স্নান করে। এই সব বিষয়ে অধিকাংশ পাশ্চাত্ত্য জাতি অপেক্ষাকৃত অপরিচ্ছন্ন। অনেক ইওরোপীয় নারী তার সন্তানের মুখ থুতু দিয়ে পরিষ্কার করে দেয়, বিড়াল যেমন করে।
কয়েকটি বিষয়ে শুচিতায় শ্রেষ্ঠ হলেও ভারতবাসীর কদভ্যাস অনেক আছে। যে অপরিচ্ছন্নতা দারিদ্রের ফল তা ধরছি না, কিন্তু যাঁরা অর্থবান ও ভদ্রশ্রেণিভুক্ত তাঁদেরও অনেক বিষয়ে শুচিতার অভাব দেখা যায়। বড় সওদাগরী আপিসে সাহেব আর দেশি কর্মচারীর জন্য আলাদা সিঁড়ি আছে। এখনকার দেশি সাহেবরাও বোধ হয় এই ব্যবস্থা বজায় রেখেছেন। পার্থক্যের কারণ কি তা সিঁড়ি দেখলেই বোঝা যায়। ভারতবাসীর বিচারে নিষ্ঠীবনের স্পর্শই ঘৃণ্য, দৃশ্য নয়, যত্র তত্র থুতু ফেলার অভ্যাস বহু লোকের আছে। দেশি সিঁড়ির স্থানে স্থানে আধার আছে, কিন্তু তাতে অভীষ্ট ফল হয় না, আধার ছাপিয়ে দেওয়ালে পর্যন্ত পানের পিকের দাগ লাগে। সাহেবী সিঁড়ির এই বীভৎস কলঙ্ক নেই। যারা পরিচ্ছন্নতা চায় তাদের পৃথক সিঁড়ি আর পৃথক সমাজ না হলে চলে না।
ক্লাব বা আড্ডায় সমশ্রেণির লোকেই স্থান পায়। বিলাতি ক্লাবে প্রবেশের নিয়ম খুব কড়া, যে কেউ ইচ্ছা করলেই সদস্য হতে পারে না। বাঙালীর আড্ডায় সাধারণত নির্দিষ্ট কয়েক জনকেই দেখা যায়, কিন্তু নূতন লোকও স্থান পায় যদি তার আচার-ব্যবহার বিসদৃশ না হয়। ক্লাব বা আড্ডার যে রীতি, দেবমন্দির বা উপাসনাগৃহেরও তাই। যিনি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন তিনি সাধারণত নিজ শ্রেণির জন্যই করেন, এই কারণে নিম্ন জাতি মন্দির প্রবেশে বাধা পায়। কালক্রমে যদি প্রতিষ্ঠাতার উত্তরাধিকারীদের স্বত্বের প্রমাণ লোপ পায় তবে সরকারী আদেশে আপামর সকলেই প্রবেশাধিকার পেতে পারে। ভারতের অনেক বিখ্যাত মন্দিরে তাই হয়েছে। কিন্তু যত দিন সে ব্যবস্থা না হয় তত দিন শ্রেণিবিচার বজায় থাকে। চণ্ডীমণ্ডপ, ভাগবতসভা, ব্রাহ্মসমাজ বা গির্জায় যদি কোন অপরিচ্ছন্ন ও কুৎসিতবেশ লোক আসতে চায় তবে তার উদ্দেশ্য ভাল হলেও সে বাধা পায়।
জাতিবিচার বা অপরিচ্ছন্নতায় আপত্তি না থাকলেও নানা কারণে ভেদজ্ঞান আসে। আকৃতি পরিচ্ছদ ভাষা খাদ্য সংস্কৃতি বিত্ত সমাজ ধর্ম দেশ রাজনীতি প্রভৃতির জন্যও শ্রেণিভেদ হয়। যেখানে অস্পৃশ্যতা নেই (যেমন মুসলমান ও ইওরোপীয় সমাজে) সেখানেও সৈয়দ ও মোমিন, শিক্ষিত ও অশিক্ষিত, ধনী ও দরিদ্র, মলিনবেশ শ্রমজীবী আর white collar মসীজীবীর সমাজ পৃথক। পাশ্চাত্ত্য দেশের অনেক হোটেলে এশিয়া আফ্রিকার লোক স্থান পায় না। কোনও কোনও রাষ্ট্রে আইন করে এই পার্থক্য নিবারণের চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু লোকমতের পরিবর্তন হয় নি। চণ্ডাল যদি শিক্ষিত সজ্জন ধনী ও ভদ্রবেশী হয় তথাপি সে নিষ্ঠাবান উচ্চবর্ণ হিন্দুর বিচারে অপাঙক্তেয়। এশিয়া-আফ্রিকার লোকের উপরেও পাশ্চাত্ত্য জাতির অনুরূপ ঘৃণা আছে।
এদেশে ধনী ও বিলাসী সমাজ সমশ্রেণি ভিন্ন বৈবাহিক সম্বন্ধ করতে চান না, পাছে শ্বশুরালয়ে মোটা চালচলনে কন্যার কষ্ট হয় বা ঘরের মর্যাদাহানি হয়। অল্পবিত্ত হিন্দু যৌথ পরিবারে অসবর্ণ বিবাহ খুব কম দেখা যায়, কিন্তু যেখানে দম্পতির নিজের আত্মীয়বর্গ থেকে পৃথক হয়ে বাস করার সামর্থ্য আছে সেখানে অসবর্ণ বিবাহ ক্রমশ প্রচলিত হচ্ছে।
ভারতের তুলনায় ইউরোপ-আমেরিকার ভদ্রসমাজে আচারগত ভেদ কম, তথাপি রাজনীতিক কারণে বিদ্বেষ দেখা যায়। ব্রিটিশ ও জার্মন জাতির উৎপত্তি ধর্ম ও সাংস্কৃতিক পার্থক্য বেশী নয়, কিন্তু যুদ্ধ বাধলেই জার্মনরা হুন আখ্যা পায়। গত যুদ্ধে মিত্রপক্ষে থাকার সময় রাশিয়া জাতে উঠেছিল, কিন্তু এখন আবার অর্ধসভ্য এশিয়াটিক হয়ে গেছে, তাদের শায়েস্তা করবার জন্য বিজ্ঞানবলী জার্মন বীর জাতির প্রয়োজন হয়েছে।