রাত বারোটা। শীতে জড়ানো মাঘের একটি রাত। মন্দিরের চত্বরে তখন আর কেউ নেই। একটা মানুষ। আর ও দিকে মন্দিরের দরজা খোলা। একটি মূর্তি রয়েছে সেখানে। একটি মূর্তি ও একটি মানুষের মাঝখানে আর কেউ নেই। কোনও জনমনিষ্যি নেই। মানুষটির কাঁধে ঢাক। তার চোখে কাপড় বাঁধা। রাত বারোটা বাজতেই ঢাকে কাঠি দেয় সে। ধীরে ধীরে বোল বাড়ে, দ্রুত হয়। আর একটি মেয়ে যেন নেচে চলে তার সামনে। টানা তিরিশ মিনিট চলে। ঢাকি ঢাক বাজায়, মেয়েটি নাচে, নাকি সামনের মূর্তিটি নড়ে ওঠে? কেউ বুঝতে পারে না, মেয়েটিকে কেউ দেখতেও পায় না। শুধু ঢাকি বুঝতে পারে, মেয়েটি নাচছে। পৌষ সংক্রান্তি থেকে মাঘ সংক্রান্তি পর্যন্ত প্রতিদিন রাতে চলে এই নাচ ঢাকের বোলে, রাত বারোটা থেকে সাড়ে বারোটা পর্যন্ত।
এটি ‘নিশিঢম্বুল’ প্রথা।
জায়গাটা কাটোয়ার মঙ্গলকোটের ক্ষীরগ্রাম। সে গ্রামের দেবী যোগাদ্যা। ৫১টি সতীপীঠের অন্যতম এটি।
সারাবছর মায়ের বিশেষ পুজোর তিথিগুলিতে যে যে তালে ঢাক বাজানো হয়, এই এক মাস এই ‘নিশিঢম্বুল প্রথায়’ সেই সারা বছরের বোলগুলিই তিরিশ মিনিটের মধ্যে বাজাতে হয় ঢাকিকে। আর সেখানেই নাচেন মা। ‘নিশিঢম্বুল’ চলাকালীন ঢাকির চোখ সাত পাক কাপড়ে বাঁধা থাকবে। তিনি নিজে ঢাক বাজালেও মায়ের নাচ তাঁর দেখা নিষেধ। কিন্তু অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে তিনি অনুভব করতে পারবেন সেই নৃত্যরত রাঙা চরণের তাল।
নিশিঢম্বুল শুরুর দিনে মকর সংক্রান্তিতে গঙ্গাস্নান করতে হয় ঢাকিকে। তখন থেকে ঢাকি মায়ের ভোগ ছাড়া বাইরে কোনও খাবার মুখে তুলতে পারেন না। নিজের বাড়িতে স্ত্রী-ছেলেমেয়ের সঙ্গে এই এক মাস থাকতে পারেন না। এমনকী নিশিঢম্বুল চলাকালীন মায়ের মন্দির চত্বরে কেউ যাতায়াত করতে পারেন না। নিশিরাতে গা ছমছমে পরিবেশে ঢাকি একাই ঢাক বাজান। অন্য কেউ সেখানে থাকবেনও না। মাঘ সংক্রান্তির দিনে বিশেষ পুজোর পর শেষ হবে নিশিঢম্বুল পূজার আচার।
এই যোগাদ্যা মন্দিরের ইতিহাস বহু পুরনো। তার সাথে যুক্ত হয়েছে নানা মিথ।
শোনা যায়, এক কালে হরি দত্ত নামে এক রাজার কাছে দেবীর স্বপ্নাদেশ আসে। তার পর শুরু হয় এই পুজো৷ প্রথম দিকে পুজো হত নরবলি দিয়ে৷ রাজা সমস্ত পরিবারের জন্য নিয়ম চালু করেন,প্রতি বছর বলি হতে হবে গ্রামেরই কোনও পরিবারের সদস্যকে। একদিন এক পূজারী ব্রাহ্মণের পালা পড়ে। একমাত্র পুত্রকে নিয়ে ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণী ভোর রাতে গ্রাম ছেড়ে পালাতে যায়। কিন্তু মাঝপথে দেবী তাঁদের দেখা দিয়ে অভয় দেন। তাঁরা গ্রামে ফিরে আসেন। সেই থেকে নরবলির পরিবর্তে শুরু হয় মহিষবলি৷ পাশাপাশি ডোম জনগোষ্ঠীর মানুষের গায়ে বেল গাছের কাঁটা ফুটিয়ে ‘নে মা, নররক্ত খা’ বলে দেবীকে রক্ত দেওয়া হয়।
দেবী যোগাদ্যার ভৈরবের নাম ক্ষীরেশ্বর বা ক্ষীরকণ্টক। সেই থেকে গ্রামের নাম হয়েছে ক্ষীরগ্রাম। আবার অনেকে বলেন,একসময় গোপেরা দুধ থেকে ক্ষীর তৈরি করতো তাই নাম ক্ষীরগ্রাম। দেবী সারা বছর শালশকটে গ্রামের পশ্চিমে ক্ষীরদিঘির জলে ডুবে থাকেন। মহাপূজার দিন তাঁকে তুলে মন্দিরে নিয়ে আসা হয়। দিঘির দক্ষিণ-পশ্চিমে বড় শাঁখারির ঘাটেই নাকি দেবী ছদ্মবেশে শাঁখারির থেকে শাঁখা কিনেছিলেন। তাই পুজোর দিন সধবারা এই ঘাটে শাঁখা কিনে দেবীকে নিবেদন করে নিজেরা পরেন।
জনশ্রুতি, দক্ষযজ্ঞের পর দেবীর ডান পায়ের বুড়ো আঙুল পড়েছিল এখানে। মধ্যযুগের তন্ত্রে ও সাহিত্যে ক্ষীরগ্রামের যোগাদ্যা দেবীর উল্লেখ আছে। কৃত্তিবাসী রামায়ণ থেকে ভারতচন্দ্র রায়ের অন্নদামঙ্গলেও পূজিতা এই দেবী।
মহাপুজো শুরু হয় বৈশাখ সংক্রান্তিতে। ওইদিন সন্ধ্যায় দেবীর পুরোহিত বা গ্রামের প্রধান হাতে সুপারি নিয়ে আশপাশের গ্রামের আগুরি সম্প্রদায়ের মানুষদের নাম ধরে ডাকেন। তাঁরা হাজিরা দিলে পুরোহিত দেবীর দিকে ফিরে ‘গ্রামের সকলে এসেছে’ বললেই ঢাকঢোল বেজে ওঠে। এটাই ‘পুজোর অনুমতি’। এ বার এক সপ্তাহ ধরে চলে এই পুজো।
শোনা যায়, প্রাচীন যোগাদ্যা মূর্তিটি একসময়ে হারিয়ে গিয়েছিল। বর্ধমানের মহারাজা কীর্তি চন্দ এ গ্রামে যোগাদ্যার একটি মন্দির নির্মাণ করান। সম্ভবত তাঁরই আদেশে হারিয়ে যাওয়া মূর্তিটির অনুকরণে একটি দশভুজা মহিষমর্দিনীর মূর্তি তৈরি করেন দাঁইহাটের প্রস্তর শিল্পী নবীনচন্দ্র ভাস্কর।
কয়েক বছর আগে ক্ষীরদিঘি সংস্কারের সময় নতুন মূর্তির সঙ্গেই উঠে আসে হারিয়ে যাওয়া পুরনো যোগাদ্যা মূর্তিটি। আনন্দে গ্রামের মানুষ গড়ে তোলেন আরও একটি মন্দির। নতুন মূর্তি পুজোর সময় ছাড়া সারা বছর জলে থাকলেও পুরনো মূর্তি এখন সারা বছরই মন্দিরে দেখতে পাওয়া যায়।