পূরাণ মতে, গণিকাদের উঠোনের মাটি ছাড়া নাকি মায়ের পূজো হয় না। আবার সেই গণিকাদেরকেই ব্রাত্য করে রাখতে পছন্দ করে এই সমাজ। তাই মূলস্রোত থেকে তাই বেশ খানিকটা দূরেই থেকে যান তথাকথিত নিষিদ্ধপল্লীর মানুষগুলো। আজও, এই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও। শুধু তাঁরাই নয়, তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মদেরকে বাধ্য করা হয় একই পেশা বেছে নিতে। তবে কেউ কেউ সেই জগদ্দল ঠেলে উঠে আসতে পারেন। ষাটের দশকে যেমন পেরেছিলেন গাঙ্গুবাই। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে যেমন পেরেছেন শ্বেতা। হয়ে উঠেছেন হাজার হাজার যৌনকর্মী ও তাঁদের পরিবারের অনুপ্রেরণা। কেমন ছিল নিষিদ্ধপল্লী থেকে সাত সাগর ডিঙানোর নেপথ্য গল্পটা। আসুন, শুনে নিই।
নিষিদ্ধপল্লী। এ যেন অন্ধকারেরই নামন্তর। এমনই একটা ধারণা পাকাপাকি ভাবে মাথায় ঢুকিয়ে বসে রয়েছে এই সমাজ। এ যেন এমন একটা পেশা, যার ছায়া মাড়াতে পর্যন্ত অস্বস্তি হয় তথাকথিত সভ্য সমাজের। আর সেই দায় বর্তায় পরবর্তী প্রজন্মের ঘাড়েও। তাই সমান অধিকার তো দূরের কথা, ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধাটুকুও থেকে যায় সেই মানুষগুলোর জন্য অধরা। তবে পতিতাপল্লীর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কি স্বপ্ন দেখা বারণ। প্রশ্নগুলো সহজ, আর উত্তরও জানা। কিন্তু কেউ কেউ সেই জানা প্রশ্ন উত্তরের সহজ সমীকরণটুকু বদলে দিতে জানেন। যেমন পেরেছেন ২২ বছরের শ্বেতা কাট্টি। নিষিদ্ধপল্লী থেকে উড়ে গিয়েছেন নিজের স্বপ্নের উদ্দেশে। সুযোগ পেয়েছেন দেশের বাইরে পড়াশোনার। লিঙ্গসাম্য নিয়ে আপাতত কাজ করছেন শ্বেতা।
মুম্বইয়ের কামাথিপুরার বাসিন্দাদের অধিকারের জন্য লড়েছিলেন গাঙ্গুবাই। সেই গাঙ্গুবাই কাঠিয়াওয়াড়ির গল্প এখন বড়পর্দার সৌজন্যে লোকের মুখে মুখে ফিরছে। সঞ্জয় লীলা বনসালি পরিচালিত ‘গাঙ্গুবাই কাঠিয়াওয়াড়ি’ সিনেমায় এই গাঙ্গুবাইয়ের চরিত্র অভিনয় করছেন আলিয়া ভাট। নিষিদ্ধপল্লীতে বিক্রি হয়ে যাওয়া অসহায় এক মেয়ে থেকে ষাটের দশকে মুম্বইয়ের ত্রাস হয়ে উঠেছিলেন গাঙ্গু। তবে গাঙ্গু যে লড়াই শুরু করেছিলেন, তা যে বিফলে যায়নি তার প্রমাণ শ্বেতা।
শ্বেতার মা ছিলেন একজন যৌনকর্মী। আর সেই কারণেই ছোট থেকে নিষিদ্ধপল্লীতেই বড় হয়ে ওঠা। সেখান থেকেই পড়াশোনা এবং শেষমেশ বিদেশে পাড়ি। না, লড়াইটা সহজ ছিল না। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা, সেই জায়গায় পৌঁছেও নিজের অতীতের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেননি শ্বেতারা। বরং সেটাকে স্বীকার করে নিয়ে সফলতার পথে পা বাড়িয়েছিলেন।
সম্প্রতি ‘গাঙ্গুবাই’ আলিয়াকে দেখে নিজের পরিচয় প্রকাশ্যে এনেছিলেন মুম্বইয়ের এক সাংবাদিক ও লেখক। তিনি জানিয়েছিলেন, তাঁর মা-ও ছিলেন মুম্বইয়ের এক যৌনকর্মী। মায়ের জন্য তাঁর গর্বের কথাও সোশ্যাল মিডিয়ায় জানিয়েছিলেন তিনি। শ্বেতার মতোই নিজের শিকড়কে অস্বীকার করেননি তিনি।
এশিয়ার সব থেকে কুখ্যাত নিষিদ্ধপল্লীর অন্যতম এই কামাথিপুরা। সেখানেই তিন বোন ও এক ভাইয়ের সঙ্গে বড় হওয়া শ্বেতার। ভাইবোনদের মধ্যে সবচেয়ে বড় শ্বেতা। একে নিষিদ্ধপল্লী, তার উপর অত্যাচারী বাবা- সব মিলিয়ে জীবনটা মোটেই সহজ ছিল না। যেখানে আশপাশের বাকি মেয়েদের জন্য নির্ধারিত ছিল নিষিদ্ধপল্লীর অন্ধকার, সেখানে অন্য পথ বাছলেন কী করে শ্বেতা?
সেই কৃতিত্ব শ্বেতা দিয়েছেন তাঁর মাকেই। হ্যাঁ, গণিকার কাজ করেই মা-ই কষ্ট করে স্কুলে পড়িয়েছেন তাঁকে। স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছেন শিকল ভাঙার। শুনতে সহজ মনে হলেও এতটা সহজ ছিল না সেই পথ। একটা সময় এমনও এসেছে, জীবনটা শেষ করে দিতে পর্যন্ত ইচ্ছা করত শ্বেতার। না, সেই ভুল করেননি শ্বেতা। মুম্বইয়ে থেকেই বারো ক্লাস পাশ করেন শ্বেতা। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকার দৌলতে প্রথম থেকে সমাজ ও রাজনীতি নিয়ে যতেষ্ট সচেতনতা ছিল তাঁর মধ্যে। সেই শিক্ষা আশপাশের মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতেন শ্বেতা। কামাথিপুরায় থাকাকালীন নিয়মিত সেখানকার ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা শেখানোর চেষ্টা করতেন শ্বেতা। ২০১২ সালে বাইরে পড়তে যাওয়ার সুযোগ আসে হঠাৎই। বুদাপেস্টের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জেন্ডার স্টাডিজ নিয়ে স্নাতকোত্তর পাশ করেন শ্বেতা।
তার পরে স্কলারশিপ পেয়ে নিউ ইয়র্কের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার সুযোগ পান। শুধু তাই নয়, একদিনের জন্য কানাডার কনস্যুল জেনারেলও হয়েছিলেন শ্বেতা। নারীর স্বাধীনতা ও ক্ষমতায়ন নিয়ে তাঁর কাজ যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বিশ্বাস করেন, শিক্ষার সেই জোর আছে, যা একজন মানুষের জীবনটাকে আমূল বদলে দিতে পারে। আর সেই শিক্ষা বোধহয় তিনি পেয়েছেন তাঁর জীবন থেকেই। তাই সেই শিকড়টাকে স্বীকার করতে কখনও ভোলেন না শ্বেতা। গাঙ্গুবাই তাঁর মতো করে দরজাগুলো খোলার চেষ্টা করেছিলেন। শ্বেতারা চেষ্টা করছেন নিজেদের মতো করে। পদ্ধতি দুটো হয়তো আলাদা, তবে গন্তব্য বোধহয় সেই একই আলোর কাছে। তাই শ্বেতারা হাজার হাজার মানুষের কাছে আজ অনুপ্রেরণা।