সামনেই মহালয়া। বীরেন্দ্রকষ্ণ ভদ্রের কন্ঠে দেবী দূর্গার স্তুতি শুনে আগ্রহী আপামোর বাঙালি। কিন্তু সদ্য নেতাজী ইন্ডোর স্টেডিয়ামে মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলের সভানেত্রী মমতা ব্যানার্জীর কন্ঠে কেষ্ট-স্তুতি অনেক তৃণমূল নেতা কর্মীর কপালে চিনাতার ভাঁজ ফেলেছে।
একদিকে শিক্ষক নিয়োগ কেলেঙ্কারিতে পার্থ চট্টোপাধ্যায় (partha Chatterjee) জেলে। গরু পাচার-কাণ্ডে কেষ্ট ওরফে অনুব্রত মন্ডল (Anubrata Mandal) জেলে। আর দুজনের কাছ থেকেই আয় বহির্ভূত বিপুল সম্পত্তি উদ্ধার করেছে সিবিআই-ইডি। তবে পার্থের নাম মুখে না এনেও কেষ্টর যন্ত্রণায় কাতর মমতার কন্ঠে কেন কেষ্ট-স্তুতি সেই প্রশ্ন করছেন প্রবীন তৃণমূল নেতা কর্মীরা।
মুখ্যমন্ত্রী সভায় জানিয়েছেন, জেল থেকে কেষ্টকে বের করতে সব রকমের চেষ্টা হবে। শুধু তাই নয়, মুক্তির দিনে তাঁকে রাজকীয় সম্বর্ধনা দেওয়া হবে। সেদিন রাজ্যে ছুটি ঘোষণা হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু দুর্নীতির শিখরে থাকা কেষ্টর জন্য মমতার এই দরদ ভাবাচ্ছে সকলকে।
এর পেছনে রাজনৈতিক অঙ্কের হিসাবই দেখছেন তাবড় নেতারা। তাঁদের মতে পার্থ জেলে থাকলে অসুবিধা নেই। কিন্তু কেষ্টর জেলের মেয়াদ বাড়া মানেই আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি বীরভূমকে কার্যত বিজেপির (BJP) হাতে তুলে দেওয়া হবে। কারণ কেষ্ট ছাড়া বীরভূম তৃণমূলের (TMC) দখলে এককভাবে থাকা প্রায় অসম্ভব।
আর এরপরেই উঠে আসছে কয়লা পাচার কান্ডে মলয় ঘটকের (Moloy Ghatak) বাড়িতে সিবিআই তল্লাশী ও টানা জেরার প্রসঙ্গ। শেষ পর্যন্ত অবশ্য কেন্দ্রীয় বাহিনীকে খালি হাতেই ফিরতে হয়েছে। কিন্তু দলের অন্দরেই প্রশ্ন উঠেছে, দল তথা মমতার অনুগত দলের দীর্ঘদিনের কর্মী-সংগঠক মলয়ের উপর কেন্দ্রীয় তদন্তকারীদের তান্ডবের পরেও কেন মমতার মুখে মলয়ের নাম উঠে আসেনি। মলয় ছাড়া যে আসানসোল (Asansole) তথা পশ্চিম ও পূর্ব বর্ধমান হাতে রাখা কঠিন হবে সেই রাজনৈতিক অঙ্ক মমতা বোঝার পরেও কেন তিনি নীরব থেকে গেলেন তা নিয়ে।
আর এখানেই সেই আরও একবার উঠে আসছে সেটিং তত্ত্ব। আসানসোল বা কয়লা শিল্পাঞ্চলে তৃণমূলের কোনও প্রভাবশালী সম্রাটের নেতৃত্বে কয়লা পাচার (Coal Smuggling) হত সেটা সেখানকার বাচ্চাতেও জানে। বাম আমলে শিল্পাঞ্চলে কিছু কয়লা মাফিয়া-পুলিশের যৌথ উদ্যোগে কয়লা পাচার হয়ে এসেছে বলে খবর। সেখানে তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার পরে দলেরই প্রভাবশালী সম্রাট পাচারের দায়িত্ব একা নিজের কাঁধে তুলে নেন। নিন্দুকেরা বলেন বাঁকুড়ার একদা তৃণমূল নেতা সৌমিত্র খাঁ (Soumitra Khan) লোকসভা ভোটের আগে দলত্যাগ করেছিলেন শুধুমাত্র ওই সম্রাটের উপর খাপ্পা হয়ে। তোলাবাজির টাকা আদায়ের জন্য এমন একটা অঙ্ক ধার্য করেছিলেন সম্রাট যে, সৌমিত্র নিরুপায় হয়ে দল থেকে বিজেপিতে চলে যান। সেখানকার তৃণমূল নেতা কিংবা সৌমিত্র নিজেই সে কথা স্বীকার করেন।
দলে থাকার তাগিদে ওই সম্রাটকে কয়া পাচার চালাতে সাহায্য করা ছাড়া কোনও কাজ ছিল না দলের অনেকেরই। সম্রাট চালিয়েছেন তাঁরই এজেন্ট অনুপ মাঝিকে দিয়ে। এই তথ্য সিবিআFয়ের জানা। সেই সম্রাটকে ধরতে সিবিআি তৈরি ছিল। অপেক্ষা ছিল সময়ের। কিন্তু হঠাৎই পট পরিবর্তনে সেই সম্রাটকে ছেড়ে এবার মলয়ের পেছনে হাত ধুয়ে কেন কেন্দ্রীয় বাহিনী পড়ে আছে, সেই প্রশ্ন তুলছেন দলের অনেকেই।
কলকাতার প্রথম সারির তৃণমূল নেতাদের কথায়, দলেরই কোনও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবশালীকে বাঁচাতেই হয়ত এবার মলয়কেই রাজনৈতিকভাবে বলির পাঠাঁ হিসাবে বেছে নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী (Mamata Banerjee)। তিনি নিশ্চিত ছিলেন এটা না করতে পারলে তাঁরই ঘনিষ্ঠের গ্রেফতারি এড়ানো অসম্ভব হয়ে পড়বে। কেষ্ট স্তুতি বজায় রাখলেও মলয়-পার্থর নাম না করে দল কী সেই সেটিং তত্ত্বকেই এবার শিলমোহর দিল।
প্রশ্ন, কাউকে ছেড়ে রাখার বিনিময়ে নিজেরই কোনও ঘনিষ্ঠকে সিবিআইয়ের হাতে তুলে দিতে সক্রিয় হয়েছে তৃণমূল (TMC)। রাজনৈতিক এই সব কথা উঠে আসবেই। নিন্দুকেরা বলছেন, গ্রেফতারির তালিকায় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় (Avishek Banerjee) ও তাঁর স্ত্রী রুজিরার (Rujira Banerjee) পরে নিজেদের মেহমান হিসাবে পেতে ফিরহাদ হাকিম (Firhad Hakim) সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি আগ্রহী ছিল সিবিআই (CBI)। সিবিআই নয়, বলা ভাল বিজেপি। কিন্তু সেটিং তত্ত্বের জনকেরা বলছেন, ফিরহাদ বা ববিকে ধরলে সবচেয়ে বেশী বিপাকে পড়েত পারেন মমতা ও তাঁর পরিবারের সদস্যরাই। তাই এদের বাঁচাতেই বা আড়াল করতে মলয়কেই কেন্দ্রীয় তদন্তকারীদের হাতে এগিয়ে দিয়েছে দল।
তবু আসানসোলবাসীর মতে, মলয় দীর্ঘদিন ধরেই মমতার ছায়া সঙ্গী হয়ে রয়েছেন। দলের নেত্রীর কথাই তাঁর কাছে সব। দলের বাইরে কোনও কথা তাঁকে বলতে শোনা যায়নি। এমনকী নেত্রীর চরমে খারাপ সময়েও মলয় নিজেকে সব সময়ে অন্তরালে রেখে পাশে থেকে গিয়েছে। দিল্লির রাজনীতিতে কিংবা দিল্লির আইনি লড়াইয়েও সেই অন্তরালে থেকে মমতা-অভিষেককে বাঁচিয়ে গিয়েছেন মলয়। এবারও রাজনৈতিক এই অঙ্ক বুঝে তিনি চুপ থাকলেও সেই মমতার কথাই তাঁর কথা হয়ে থাকবে।