কলমে ধ্রুবজ্যোতি প্রামানিক, বিশিষ্ট সাংবাদিক
একটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড….
লেখার শুরুতেই একটি অনুরোধ। আমার ফেসবুক পেজে বহরমপুর এবং মুর্শিদাবাদের যত মানুষ আছেন, আমার ফলোয়ারদের মধ্যেও যাঁরা মুর্শিদাবাদ আর বহরমপুরের মানুষ, তাঁরা এই লেখা আমাদের প্রাণের শহর আর জেলার কোণায় কোণায় ছড়িয়ে দিন।
এই লেখার একটা প্রেক্ষাপট আছে। কয়েকদিন আগে দেখলাম, আমার শিক্ষক এবং রাজনৈতিক গুরু, দেবজ্যোতি বিশ্বাসের একটি পোস্ট। ২৫ ফেব্রুয়ারির সেই পোস্টে দেবজ্যোতিদা লিখেছেন, সম্পাদক হিসেবে, কৃষ্ণনাথ কলেজে প্রাক্তনী সংসদের একটি সভা ডাকছেন তিনি। সভার আলোচ্য, কীভাবে, গায়ের জোরে, ইতিহাসকে অস্বীকার করে, শুধুমাত্র ভোটের অঙ্ক মাথায় রেখে, ২০১৮ সালে, ঐতিহাসিক কৃষ্ণনাথ কলেজের নাম বদলে, মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় করে দেয় সরকার। প্রতিবাদ আন্দোলন সংগঠিত করতেই ২ মার্চ, কৃষ্ণনাথ কলেজেই সভা। ভেবে দেখলাম, ঠিক ওই দিন, বহরমপুর থেকে আমি অনেক দূরে থাকব। দিল্লি থেকে মুম্বই উড়ে যাব। তাই, মন চাইলেও, কৃষ্ণনাথ কলেজের এক গর্বিত প্রাক্তনী হিসেবে ওই সভায় আমি থাকতে পারব না। প্রতিবাদ জানাতে তাই সমাজমাধ্যমকেই হাতিয়ার করলাম।
এই লেখায়, লিপিবদ্ধ ইতিহাসের প্রয়োজনীয় অংশ উল্লেখ করে আমি প্রমাণ করব, কেন এই লেখার শিরোনাম, একটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। প্রথমেই জানুন, মুর্শিদাবাদের জেলা সদর, বহরমপুর শহরে, ভাগীরথী তীরে অবস্থিত কৃষ্ণনাথ কলেজের নাম কৃষ্ণনাথ কলেজ (Krishnanath College) কেন হয়েছিল। কে এই কৃষ্ণনাথ ? এই কলেজ স্থাপন, শিক্ষার প্রসারে তাঁর কী ভূমিকা ছিল ?
ঐতিহাসিক কৃষ্ণনাথ কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকেও পুরনো। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (Calcutta University) স্থাপিত হয়, ১৮৫৭ সালে। আর একদা বহরমপুর কলেজ, পরবর্তী কালে যার নাম হয় কৃষ্ণনাথ কলেজ, তার পথ চলা শুরু, ১ নভেম্বর, ১৮৫৩। কৃষ্ণনাথ কলেজ স্থাপনের একটি বৃহৎ এবং সমৃদ্ধ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। আমি শুধু সেই সময় সরণির প্রয়োজনীয় অংশই এখানে তুলে ধরব। ১৭৫৭ সাল। পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব, সিরাজউদ্দৌল্লা। অখণ্ড ভারতে শুরু ব্রিটিশ রাজ। ১৭ শতকের শেষের দিক থেকে ব্রিটিশ সাহচর্যের সুবাদেই বাংলায় এল নবজাগরণ। সূরা-নারী-বুলবুলির বাবু কালচার পিছনে রেখে, বাঙালি পা বাড়াল, আলোকপ্রাপ্তির পথে। শিক্ষা ও জ্ঞান লাভের সেই আকুতি ছড়িয়ে পড়ল বাংলায়। সেই সময়, আলোক-অন্বেষণে অগ্রগণ্য জনপদের নাম বহরমপুর। শহরে একটি ইংরেজি শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ শুরু হল। আর সেই উদ্যোগের পুরোধা পুরুষ কাশিমবাজার রাজ পরিবারের সন্তান, কৃষ্ণনাথ। বয়স তখন মাত্র ১৫। জনসাধারণ, আমলা, অমাত্য, জমিদাররা সব অর্থ দান করলেন। সংগৃহীত হল ৭০০০ টাকা। এর মধ্যে ২০০০ টাকা দান করলেন, ১৫ বছরের যুবরাজ কৃষ্ণনাথ। একটি ইংরেজি শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপিতও হল। যদিও তার আয়ু বেশিদিন ছিল না। কৃষ্ণনাথের জ্ঞান পিপাসা মিটল না। ১৮৪১ সালে, মাত্র ১৯ বছর বয়সে, কাশিমবাজার রাজ পরিবারের রাজত্ব এল কৃষ্ণনাথের হাতে। কিশোর রাজার চোখ জুড়ে স্বপ্ন। কাশিমবাজারের (Cossimbazar) বানজেটিয়ায় তিনি গড়বেন স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে কলা, বিজ্ঞান, আইন তো বটেই, পড়ানো হবে চিকিৎসা বিজ্ঞানও। কিন্তু স্বপ্ন থেকে গেল অধরাই। ২২ বছর বয়সে আত্মহনন করলেন, রাজা কৃষ্ণনাথ। কিন্তু স্বামীর স্বপ্নের কথা জানতেন, স্ত্রী। রানি স্বর্ণময়ী।
শেষমেশ, বহু কাঠখড় পুড়িয়ে, ১৮৫৩ সালে শুরু হল বহরমপুর কলেজ। ১ নভেম্বর। তার আগে, সেপ্টেম্বর মাসে, বহরমপুর শহরে একটি সভা ডাকা হয়। উদ্দেশ্য অর্থ সংগ্রহ। ওই সভাতেই ২০ হাজার টাকা সংগৃহীত হয়। সেপ্টেম্বর মাস জুড়ে চলে অর্থ সংগ্রহ অভিযান। মোট প্রায় ৩০ হাজার টাকা অনুদান পাওয়া যায়। যার মধ্যে সর্বাধিক, ৪ হাজার টাকা একাই দান করেন, রানী স্বর্ণময়ী। ১৮৫৩ সালের ১ নভেম্বর শুরু হয় কলেজ। শুরুর বছরগুলিতে কোনও স্থায়ী ভবন ছিল না। অবশেষে, ২৯ জুলাই , ১৮৬৩ সালে, ভাগীরথী তীরে, ২১ বিঘা, ৮ কাঠা, ৯ ছটাক জমিতে বর্তমান ভবনের শিলান্যাস করেন বাংলার তৎকালীন লেফটেন্যান্ট গভর্নর, সিসিল বিডন। নির্মাণ শেষে, ২৮ জুন, ১৮৬৯ সালে এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে কলেজের শুভ উদ্বোধন হয়। ভাগীরথী তীরে সেদিন, বিডন সাহেবকে তোপধ্বনি দিয়ে স্বাগত জানায় রানি স্বর্ণময়ীর লাইট ইনফ্যান্ট্রি।
বহরমপুর ( berhampur) কলেজ অচিরেই জ্ঞানচর্চা এবং শিক্ষাসাধনার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হল। কিন্তু কলেজের ভবিষ্যত নিয়ে বড় প্রশ্নচিহ্ন উঠল কয়েকবছর পরেই। ব্রিটিশ তখন শিক্ষানীতির পরিবর্তন ঘটালো। ১৮৭০ সাল নাগাদ ঘটছে এই কাণ্ড। প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং হুগলি কলেজ চালিয়ে, বহরমপুর এবং কৃষ্ণনাথ কলেজ দুটিও চালানোর ব্যাপারে বেঁকে বসল ব্রিটিশ। কিশোরী রানি স্বর্ণময়ী তখন পরিণত নারী। এগিয়ে এলেন সেই প্রাতস্মরণীয়া। ১৮৮৬ সালে ব্রিটিশকে চিঠি লিখলেন। বললেন, কলেজ বাঁচাতে তিনি বছরে ১২ হাজার টাকা দেবেন। মহিয়সী রানীর বদান্যতায় কলেজ বাঁচল। ১৮৯৭ সালে প্রয়াত হলেন, রানি স্বর্ণময়ী। তাঁর মৃত্যুর পর, যোগ্য উত্তরাধিকারী হিসেবে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে এলেন, কাশিমবাজার রাজ পরিবারের, রাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী। কলেজের জন্য বার্ষিক অনুদান বেড়ে হল, ২০ হাজার টাকা। ইতিহাস বলছে, রাজা মণীন্দ্রচন্দ্র, তাঁর জীবদ্দশায়, বহরমপুর কলেজ এবং কলেজিয়েট স্কুলের জন্য প্রায় ১ কোটি টাকা দান করেন। রাজা মনীন্দ্রচন্দ্রই তাঁর মামা, রাজা কৃষ্ণনাথের নামে কলেজের নামকরণের প্রস্তাব দেন। ১৯০৩ সালে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট তা অনুমোদন করে। বহরমপুর কলেজের নাম হয় কৃষ্ণনাথ কলেজ।
এই সমৃদ্ধ ইতিহাসকে অগ্রাহ্য করে, উপেক্ষা করে, জলাঞ্জলি দিয়ে, কৃষ্ণনাথ কলেজের নাম তবে মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় করা হল কেন !! সেই কথা বলব। তার আগে আসুন, মুর্শিদাবাদ নামটা কোথা থেকে এল, সেটা বলি।
ইতিহাসের একটি মত হল, ১৪৯৩ থেকে ১৫১৯ সালের মধ্যে, নানকপন্থী সন্যাসী, মুকসুদন দাস, ভাগীরথী তীরে একটি নগর পত্তন করেন। তাঁর নাম অনুসারেই নগরের নাম হয়, মুকসুদাবাদ। এরপর কেটে যায়, দু দুটি শতক। ১৭০০ সালে, ঔরঙ্গজেব, মুর্শিদকুলি খাঁকে বাংলার দেওয়ান এবং মুকসুদাবাদের ফৌজদার নিযুক্ত করেন। ১৭০৪ সালে, মুর্শিদকুলি, প্রাদেশিক রাজস্ব আদায়ের কেন্দ্র, ঢাকা থেকে মুকসুদাবাদে স্থানান্তরিত করেন। ব্রিটিশের নয়নের মণি মুর্শিদকুলি খাঁকে নবাব নাজিম উপাধি দেওয়া হয়। মুকসুদাবাদের নাম পরিবর্তন করে মুর্শিদাবাদ রাখেন মুর্শিদকুলি। পরবর্তীতে নবাবি যায় আলিবর্দি খাঁয়ের হাতে। এই আলিবর্দিরই নাতি, বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব, সিরাজউদ্দৌল্লা। পলাশীর যুদ্ধে সিরাজের সেনাপতি মীরজাফরের নিমকহারামি, ভাগীরথী তীরে বাংলার স্বাধীনতা সূর্যের অস্ত, ইতিহাস বইয়ের পাঠ্য। সবাই জানেন। আমার প্রশ্ন, কৃষ্ণনাথ কলেজ প্রতিষ্ঠার নান্দীমুখ বা সলতে পাকানোর কাজ শুরু যখন, পলাশীর যুদ্ধ তখন প্রায় ১০০ বছরের ইতিহাস। মুর্শিদাবাদের সেই নবাবিও নেই, নেই কোনও ভূমিকাও। তাহলে কৃষ্ণনাথ কলেজের নাম বদল করে মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় কার স্বার্থে ?
এই ইতিহাস আসলে দেড় দশকের পুরনো। ৩৪ বছরের বাম জমানার অবসান ঘটিয়ে ২০১১ সালে বিশ্ব বাংলায় দণ্ডাব্দের সূত্রপাত। বাংলায় যেহেতু ২০১১ সাল থেকে উন্নয়ন রাস্তায় দণ্ডায়মান, আমি মনে করি, খ্রিষ্টাব্দকে অতিক্রমণ করে, বিশ্ব বাংলায় তখন থেকেই দণ্ডাব্দের শুরু। কিন্তু বাংলার ভাগ্যাকাশের সেই সন্ধিক্ষণেও, মুর্শিদাবাদ জেলায় তেমন দাঁত ফোঁটাতে ব্যর্থ শাসক দল। বহু চেষ্টা সত্ত্বেও ২০১৪ সালের লোকসভাতেও ব্যর্থ। ঐতিহাসিকভাবে কংগ্রেস এবং বামেদের জেলায় ঘাসফুল চাষের জন্য তাই শুরু হল নানা কৌশল। মুর্শিদাবাদ দরিদ্র, পিছিয়ে পড়া জেলা। গ্রামে গ্রামে নিরক্ষর, অর্ধ শিক্ষিত, অশিক্ষিত গরিব মুসলমানের বাস। অশিক্ষা আর দারিদ্র্য, মৌলবাদী রাজনীতির জন্য উর্বর জমি। অতএব ? দাও মৌলবাদে সুরসুরি। দাও মোল্লাতন্ত্রের গোঁড়ায় হাওয়া। ইতিহাস মুছে দাও। মুর্শিদকুলির নাম চালাও। ঐতিহাসিক কৃষ্ণনাথ কলেজ তাই ২০১৯ এর লোকসভা ভোটের ঠিক আগে হয়ে গেল মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়। ২০১৯ লোকসভা আর ২০২১ বিধানসভায় হাতেনাতে ফল। ২০২৪ লোকসভায়, “উনি পাঁচ ওয়াক্ত নমাজ পড়েন” কে মাঠে নামিয়ে মুর্শিদাবাদ দখল পূর্ণ হল। অথচ জানেন, কৃষ্ণনাথ কলেজের জন্য যখন অর্থ সংগ্রহ চলছে, যে হাজার হাজার মানুষ তাতে যা পেরেছেন দিয়েছেন, তার মধ্যে বহরমপুর শহরের অদূরে হরিহরপাড়ার রুকুনপুর গ্রামের ৮০ জন দরিদ্র কৃষকও ছিলেন। এঁদের বেশিরভাগই ছিলেন মুসলিম।
বহরমপুর শহরে জন্ম আমার। কৃষ্ণনাথ কলেজে সক্রিয় বাম ছাত্র রাজনীতি করেছি। অসংখ্য শিক্ষিত আর উদারমনস্ক মুসলিম আমার বন্ধু। তাই দায়িত্ব নিয়ে বলছি, জেলার শিক্ষিত, উদারমনস্ক মুসলিমরাও এভাবে ইতিহাস মুছে দিতে চাননি। কেউ চাননি, এই রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। নাম বদল ছাড়া কিচ্ছু হয়নি, জানেন। কৃষ্ণনাথ কলেজের জমি বাড়েনি এক ছটাক। পরিকাঠামো অপরিবর্তিত। অধ্যাপকরাও সব এক। তাহলে ? কী উদ্দেশ্যে রাজ্যের উচ্চশিক্ষার মহাফেজখানায় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম যোগ করে দেওয়া হল !!
আমি কৃষ্ণনাথ কলেজের গর্বিত প্রাক্তনী। আমার কলেজে পড়েছেন কত দিকপাল। আমার বাবা এই কলেজের ছাত্র। আমার ভাই পড়েছে এই কলেজে। আমার গোটা পরিবার পড়েছে কৃষ্ণনাথ কলেজে। বহরমপুর শহরের সব রাস্তায়, সব গলিতে আজ হাঁটছেন যাঁরা, তাঁদের বহু জন এই কলেজের প্রাক্তনী। সবাই আসুন। প্রতিবাদ হোক। জোরদার। আমাদের তো সবাই নিমকহারামের জেলার লোক বলে ! এই কলেজ আমাদের শিক্ষা দিয়েছে। ডিগ্রি দিয়েছে। যৌবন দিয়েছে। প্রশ্ন করতে শিখিয়েছে। পথে নামবেন না ? কলেজকে ফিরিয়ে দেবেন না হৃতগৌরব ? এক কিশোর রাজা আর তাঁর বিধবা রানিকে কৃতজ্ঞতা ফিরিয়ে দেবেন না ? বুক বাজিয়ে একবার বলবেন না, দেখুন রানিমা, আমরা নিমকহারাম নই ? দেখুন আমরা একজোট হয়েছি। পথে নেমেছি। মিছিলে হাঁটছি। বলবেন না ?
তথ্য ঋণ : সার্ধশতবর্ষে কৃষ্ণনাথ কলেজ- অধ্যাপক বিষাণ কুমার গুপ্ত।
মুর্শিদাবাদ জেলা গেজেটিয়ার।