কেন আষাঢ় মাসের পূর্ণিমার দিনটিতেই গুরুপূর্ণিমা বলে মনে করা হয়?
সনাতন ধর্মে কেন এই বিশেষ সময়টিই গুরুপূর্ণিমা হিসেবে চিহ্নিত? ব্যাখ্যা রয়েছে শিবপুরাণে (shiv puran)। সেখানে বলা হচ্ছে, আষাঢ় মাসের পূর্ণিমার দিনই জন্মেছিলেন মহর্ষি বেদব্য়াস। পুরাণ অনুযায়ী, মহর্ষি বেদব্যাস শ্রীবিষ্ণুর অবতার। সাধারণ মানুষকে চতুর্বেদের জ্ঞান দিয়েছিলেন বলে তাঁকেই প্রথম গুরু হিসেবে গণ্য করা হয়। তাই বিশেষ পূর্ণিমাটি (purnima) ব্যাসপূর্ণিমা নামেও পরিচিত। ১৩ জুলাই সেই পূর্ণিমারই উদযাপন।
রীতি অনুযায়ী, গুরুপূর্ণিমার (Guru Purnima) দিন গুরুর পুজো করার কথা। অনেকে তাঁদের সেবাও করেন। অনেকের ধারণা, মহর্ষি বেদব্যাসও এই দিনটিতে তাঁর গুরুর অর্চনা করতেন। বস্তুত গুরু-শিষ্য় সম্পর্কের ধারা এ দেশের মাটিতে যে বহু বছর ধরে চলে আসছে, এই পূর্ণিমা তার প্রমাণ। ভারতীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, শিষ্যকে অন্ধকারের হাত থেকে রক্ষা করে যিনি আলোর দিকে নিয়ে যান, তিনিই গুরু। তবে এদেশের সংস্কৃতিতে শুধু গুরু নন, পরিবারের সকল বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য়ই গুরুর মতো সম্মানের অধিকারী।
পুরাণ তো বটেই, ভারত তথা গোটা বিশ্বের ইতিহাসের নিরিখে বহু বিশিষ্ট ব্য়ক্তিত্ব সাধারণ মানুষের জীবনে গুরুর ভূমিকা বার বার বর্ণনা করে গিয়েছেন।
স্বামী বিবেকানন্দ (Swami Bibekananda)
গুরু পরম্পরা থেকে যে আধ্য়াত্মিক শক্তি পেয়েছেন তিনিই সদগুরু, মনে করতেন স্বামী বিবেকানন্দ। শিষ্যের অন্যায়-অপরাধ সব নিজের উপর নেন তিনি।
তুলসীদাস
‘রামচরিত মানস’-এ তুলসীদস লিখেছিলেন, ‘গুরু বিন ভাবনিধি তরই না কোই।’ সহজ কথায় যার অর্থ গুরুর দাক্ষিণ্য ছাড়া বিশ্ব মহাসাগর থেকে আত্মার মুক্তি সম্ভব নয়।
শুধু গম্ভীর দর্শন নয়, সাহিত্যেও গুরুর ভূমিকা উঠে এসেছে বার বার। ‘দেশে বিদেশে’থেকে শুরু করে একাধিক লেখায় বার বার গুরুদেব অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা বিশেষ ভাবে বলে গিয়েছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলি। এমন আরও উদাহরণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আশপাশে।
সেই সমস্ত গুরুদের অর্চনা জানাতেই এই দিন।
গুরু পূর্ণিমায় মহাযোগ
এই বছর গুরু পূর্ণিমায় গ্রহ ও নক্ষত্রের অবস্থান খুব বিশেষ হতে চলেছে। গুরু পূর্ণিমার দিনে আশ্চর্যজনকভাবে এই বছরেই বিরল নজির তৈরি করে ৪টি রাজযোগ গঠন হতে চলেছে। এইদিন মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি ও শনির অবস্থানের কারণে ৪টি রাজযোগ তৈরি করছে। এই দিনে রুচক, ভাদ্র, হংস ও শশা নামে ৪টি রাজযোগ গঠিত হতে চলেছে। এছাড়াও মিথুন রাশিতে সূর্য-বুধের সংযোগও বুধাদিত্য যোগ করছে। বহু বছর পর বুধাদিত্য যোগে গুরু পূর্ণিমা উদযাপিত হতে চলেছে যেটিকে খুবই শুভ যোগ বলে মনে করা হয়ে থাকে। জ্যোতিষশাস্ত্রে এমন এইধরণের ঘটনা খুবই শুভ বলে মনে করা হয়।
গুরু পূর্ণিমার মাহাত্ম্য
মহর্ষি বেদ ব্যাস মহাভারত রচনা করেছিলেন। এই মহান ঋষি দ্বাপর যুগে এই দিনেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি একাধিক পুরাণ রচনা করেছিলেন এবং বেদও বিভক্ত করেছিলেন। আর তাঁর সম্মানেই আষাঢ় মাসের পূর্ণিমা তিথিকে গুরু পূর্ণিমা হিসেবে পালন করা হয়। এই বছর, অর্থাৎ ২০২২ সালে মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি ও শনির অবস্থান চারটি রাজযোগ সৃষ্টি করছে, এর বাইরে বুধাদিত্য প্রভৃতি অনেক শুভ যোগ তৈরি হচ্ছে। রুচক, ভাদ্র, হংস ও শশা, এই চারটি রাজযোগ গঠিত হতে চলেছে গুরু পূর্ণিমায়, যা এই দিনটিকে আরও বিশেষ বানাবে। সেইসঙ্গে এবার বুধাদিত্য যোগে গুরু পূর্ণিমার উৎসব পালিত হবে।
গুরুদেবের উপাসনা
যদি কোনও ব্যক্তির দীক্ষাগুরু বা মন্ত্রগুরু না থাকেন তবে সেই ব্যক্তিও গুরু পূর্ণিমা পালন করে পূজা করে শুভ ফল পেতে পারেন। সকল বেদ ও পুরাণ অনুযায়ী, ভগবান মহাদেব হলেন পরম গুরু। এইদিনে তাঁর পুজো করা আর গুরুর পুজো করা সমকক্ষ। যেহেতু শ্রীকৃষ্ণকে অর্জুন নিজের গুরু হিসেবে মেনেছিলেন তাই এই দিনে কৃষ্ণর উপাসনা করাও শুভ। এছাড়াও যাঁদের কুণ্ডলীতে বৃহস্পতি গ্রহ প্রতিকূল অবস্থানে রয়েছে, তাঁদের বিশেষ করে বৃহস্পতি গ্রহের পূজা করা উচিত। যে সমস্ত মানুষদের দাম্পত্য জীবনে সমস্যা দেখা দেয় বা বিষয়গুলি প্রতিনিয়ত খারাপ হতে থাকে তাঁরা যদি গুরু পূর্ণিমায় বৃহস্পতি গ্রহ সংক্রান্ত কোনও জ্যোতিষ উপায় গ্রহণ করেন, তাহলে তাদের বিবাহের যোগ শীঘ্রই তৈরি হতে পারে। যেহেতু এই সময় বিশেষ রাজযোগ তৈরি হচ্ছে, তাই এই নির্দিষ্ট দিনে পুজো করাও খুব শুভ। কোনো রাশির জাতক জাতিকাদের যদি বৃহস্পতি সমস্যা করে তাহলে এইদিনটিতে গুরু পুজো করলে সব বিপত্তি দূরে চলে যাবে। জীবনে চলার পথে অনেক বাধা আসে, সেই বাধা অতিক্রম করতে চাইলে বৃহস্পতি গ্রহের পুজো করা উচিৎ।
গুরু মন্ত্রের শুভ মুহূর্ত
গুরু পূর্ণিমার দিন বহু মানুষ নিজের গুরুদেব নির্ধারণ করেন এবং দীক্ষা নিয়ে থাকেন। ২০২২ সালে হতে চলা গুরু পূর্ণিমার দিন সকাল ৭টা থেকে ইন্দ্রযোগ শুরু হতে চলেছে, যা থাকবে বেলা ১২টা বেজে ৫০ মিনিট পর্যন্ত। এই সময়ের মধ্যে যারা দীক্ষা নিতে চান তাঁদের জন্য দীক্ষা নেওয়ার সবথেকে ভালো সময় হিসেবে নির্ধারিত রয়েছে। সেই সঙ্গে এই বছরে গঠিত হওয়া মহাযোগগুলির ফলে ফল আরও শুভ হবে। এই শুভক্ষণে গুরুর উপাসনা করলে জীবনে সব ইচ্ছা পূরণ হয়।