রাজু ঝা সহ কয়েকটি খুনের তদন্ত নিয়ে প্রশ্নের মুখে বর্ধমানের শক্তিগড় থানার পুলিশ। তারই মাঝে এবার বর্ধমানের বেসরকারি স্কুলের সচিবের বিরুদ্ধে এক মহিলা শ্লীলতাহানি-হুমকি সহ একাধিক জামিন অযোগ্য ধারায় থাকা অভিযোগপত্র জমা পড়ল শক্তিগড় থানা। সকলের উপস্থিতিতে শ্লীলতাহানি ও হুমকির ভিডিও ফুটেজ (দেখুন সেই ভিডিও) হাতে পেলেও প্রথমে পুলিশ অভিযোগ নিতে অস্বীকার করে। পরে স্কুলের শিক্ষক-অশিক্ষক কর্মচারীদের চাপে প্রায় ঘন্টা দুয়েকের বাক-বিতন্ডার পরে অভিযোগ নেয় পুলিশ। অভিযোগ, কর্মচারীদের প্রতিবাদে ক্ষিপ্ত হয়ে সচিব বেতনের চেকে সই না করায় শুক্রবার কর্মচারীদের বেতন থমকে গিয়েছে। এরই মাঝে শনিবার স্কুলের মর্নিং সেকসনের শিক্ষকদের সঙ্গে অবিভাবকদের মিটিং রয়েছে।
বর্ধমানের সেন্ট পলস অ্যাকাডেমি (ST.PAULS ACADEMY) নামে ওই স্কুলের এই ঘটনায় মহিলার পাশে দাঁড়িয়েছেন স্কুলেরই সব শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মচারীরা। তাঁরা সম্মিলিতভাবে ঘটনার ভিডিও ফুটেজ সহ একাধিক প্রমাণপত্র নিয়ে থানায় হাজির হন। তাঁদের প্রথমে শূন্য হাতেই ফিরিয়ে দেন ডিউটি অফিসার। দাবী, প্রথমে অভিযোগ নিতে রাজি হলেও পরে থানার ওসি দীপক সরকারের নির্দেশে ওই অভিযোগ পরে নিতে অস্বীকার করেন ডিউটি অফিসার। পরে অবশ্য তা পুলিশ গ্রহণ করে বলে খবর। তবে পুলিশ সূত্রে এখনও কোনও বক্তব্য জানানো হয়নি।
রীতা মজুমদার নামে ওই মহিলার অভিযোগ (অভিযোগপত্র দেখুন), স্কুলে বেশ কিছু দিন ধরেই স্কুলের সচিব বিজয় গুপ্তের (Bijay Gupta) সঙ্গে টিচার্স কো-অর্ডিনেটর তন্নু চৌধুরীর অসামাজিক ও অনৈতিক কীর্তিকলাপ চলছে। তাঁদের তাণ্ডবে সকলের প্রাণ ওষ্ঠাগত। এরই মাঝে সচিব আচমকাই তাঁর উপর হামলা চানা, শ্লীলতাহানি করেন। প্রাণে মারতে গলা টিপে ধরেন। এটা সকলের সামনেই হয়েছে। ঘটনাস্থলে উপস্থিত শিক্ষকরেরা কোনও রকমে সচিবকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে প্রাণে বাঁচান। এরপর থেকেই লাগাতার কাজ থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার হুমকি চলছে। এমনকী এদিন বিকালে তাঁকে একা পেয়ে সচিব ফের গালিগালাজ করে স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেন। ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা হলেও বিজয়কে পাওয়া যায়নি।
অভিযোগ, বেশ কিছুদিন ধরেই ওই স্কুলের সচিব বিজয় গুপ্তা ও তাঁর ঘনিষ্ঠ প্রাক্তন কো-অর্ডিনেটরে তন্নু চৌধুরীর বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ নিয়ে সরব হয়েছেন স্কুলেরই শিক্ষক-অশিক্ষক কর্মচারীরা। তাঁদের অভিযোগ, এই দুজনের লাগাতার তাণ্ডবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে স্কুলের পঠন পাঠন। অবিভাবকেরা স্কুলে গিয়ে প্রতিবাদে সামিল হচ্ছেন। স্কুলের মর্নিং সেকসনের দায়িত্বে তাঁরা ছিলেন। একপ্রকার মানসিক নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে স্কুলের শিক্ষক-অশিক্ষক কর্মচারীরা একযোগে জেলার জেলাশাসক ও পুলিশ সুপারকে লিখিত অভিযোগ দেন।
কিন্তু সেই অভিযোগকে কোনও গুরুত্ব না দিয়েই শক্তিগড় থানার পুলিশ (Saktigarh Police Station) বিজয় গুপ্তের লাগাতার অভিযোগ নিয়ে কার্যত অতিষ্ঠ করে তুলেছেন স্কুলের শিক্ষক অশিক্ষকদের। পুলিশি এই তাণ্ডব থেকে রেহাই পাননি স্বয়ং চেয়ারম্যান সঞ্জয় গুপ্তা। তিনি ও কয়েকজন কর্মচারী জামিন নিয়ে কাজ চালাচ্ছেন। অভিযোগ, সচিবের হাত থেকে সরিয়ে স্কুলের প্রিন্সিপালের নেতৃত্বে স্কুল চালানোর মতো কড়া সিদ্ধান্ত নেওয়ায় সচিব বর্তমানে লাগাতার অভিযোগ-মামলা দাখিল করে যাচ্ছেন। এমনকী, স্কুলের হাল পেরাতে চেয়ারম্যান শহরের বিশিষ্টদের নিয়ে ম্যানেজিং কমিটি গঠন করেন। ঠিক ছিল স্কুলের পরিচালন ট্রাস্টি সদস্যেরা নয়, এই ম্যানেজিং কমিটিই স্কুলের শিক্ষা সংক্রান্ত সব সিদ্ধান্ত নেবেন। কিন্তু সচিব বিজয় সেই ম্যানেজিং কমিটির বিরুদ্ধেই মামলা করেছেন। আদালতের নির্দেশে আপাতত এই কমিটির কাজ স্থগিত রয়েছে।
ঘটনার সূত্রপাত চলতি মাসের শুরুতে। ওই কো-অর্ডিনেটরের তাণ্ডব, স্কুলের অন্দরে একটানা সচিব ও কো-অর্ডিনেটরকে আপত্তিজনক ঘনিষ্ঠ মূহূর্তের খবর নিয়ে অতিষ্ঠ হয়ে শিক্ষক-অশিক্ষকেরা প্রথম অভিযোগ জানান চেয়ারম্যানের কাছে। দাবি করা হয়, তাঁরা যেভাবে স্কুলে কীর্তি করছেন, অত্যাচার চালাচ্ছেন তাতে শিক্ষার মান পড়ে যাচ্ছে। এর জেরেই হস্তক্ষেপ করেন চেয়ারম্যান। তিনি ওই কো-অর্ডিনেটরের ঘনিষ্ঠ এক অস্থায়ী অশিক্ষক কর্মচারীকে সাময়িক ছুটিতে পাঠিয়ে দেন। আর এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে গত ৪ এপ্রিল সচিব বিজয় গুপ্তা সকলের উপস্থিতিতেই ওই স্কুলের অশিক্ষক মহিলা কর্মচারীদের দায়িত্বপ্রাপ্তের উপর হামলা চালান। তাঁকে কার্যত গলা ধাক্কা দিয়ে শ্লীলতাহানি করেন। কোনও প্রকারে সেখানে উপস্থিত শিক্ষকেরা সচিবকে সেখান তেকে কার্যত সরিয়ে নিয়ে যান।
এর পরেই ওই বিজয় ও কো-অর্ডিনেটরের মদতে সাময়িক ছুটিতে পাঠানো মহিলাকে দিয়ে স্কুলের চেয়ারম্যান সহ একাধিক কর্মীর বিরুদ্ধে শক্তিগড় থানায় জামিন অযোগ্য ধারায় অভিযোগ দায়ের করান। পুলিশ সেই সময়ে বিনা তদন্ত ও খোঁজ খবরে জামিন অযোগ্য ধারায় মামালা রুজু করে। এই ঘটনার কোনও তথ্য বা নথি বা প্রমাণ পুলিশের কাছে পেশ করা যায়নি বলেই সূত্রে খবর।
মহিলার উপরে বিজয়ের হামলার ভিডিও ফুটেজ ভাইরাল হতেই প্রায় পাঁচ শতাধিক মর্নিং সেকসনের অবিভাবকেরা স্কুলে বিক্ষোভে সামিল হন। তাঁরা চেয়ারম্যানের কাছে লিখিতভাবে হস্তক্ষেপ চেয়ে স্মারকলিপি দেন। অবিভাবকদের চাপে সেদিনই বিকালে ওই কোঅর্ডিনেটর পদত্যাগ করেন। কিন্তু সেই পদত্যাগ নিয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন সচিব। অভিযোগ, প্রায় চার তিন শতাধিক কর্মচারীদের বেতনের জন্য চেয়ারম্যান চেক সই করে দিলেও তা ফিরিয়ে দেন সচিব। ফলে আটকে গিয়েছে কর্মচারীদের বেতন।
অভিযোগ, শক্তিগড় থানার পুলিশ নিরপেক্ষ হয়ে কাজ করছে না। স্কুকে বাঁচাতে স্কুলেরই চেয়ারম্যান-শিক্ষক-অশিক্ষক কর্মচারীরা একযোগে কাজ করার চেষ্টা করলেও পুলিশকে সাথে নিয়ে সচিব নানান ভাবে তাতে বাধ সাধছেন। আর এতেই ক্ষিপ্ত হচ্ছেন প্রায় হাজার পাঁচেক অবিভাবক ও ছাত্র-ছাত্রী। কার্যত স্কুলের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে প্রশাসনের একাংশ সচিবের পক্ষ নিয়ে আড়ালে আবডালে কাজ করায় অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে স্কুলের ভবিষ্যতই।