খবরে আমরাঃ শুভ বিষ্যপুরাণে এক অহংকারী ব্রাহ্মণের কাহিনি। ব্রাহ্মণ কাউকে কোনওভাবে সাহায্য করেন না। একদিন ক্ষুৎপিপাসায় কাতর এক ব্যক্তি ব্রাহ্মণের কাছে জল চাইলে তৎক্ষণাৎ ওই ব্রাহ্মণ তার মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেন। তারপর বন্ধ ঘরের ভিতর থেকে বললেন যে, তাঁর ঘরে খাবার-দাবার, জল দেওয়ার মতো কিছুই নেই। ব্রাহ্মণ-পত্নী দয়াবতী। তিনি স্বামীর নিষেধ অমান্য করে তৃষ্ণার্ত ব্যক্তিটিকে অন্ন ও জলদান করলেন।
মৃত্যুর পর ব্রাহ্মণের বিদেহী আত্মার ঠাঁই হল যমলোকে। সেখানে অন্ন-জল বিনা নিদারুণ কষ্টে দিন কাটে আত্মার। অবশেষে পত্নীর পুণ্যকর্মে একসময় যমলোক থেকে মুক্তি পেল আত্মা। ব্রাহ্মণ পুনর্জন্মলাভ করলেন। এই জন্মে অক্ষয় তৃতীয়ার ব্রত ভক্তিভরে পালন করে যশস্বী হলেন ব্রাহ্মণ। বিগত জন্মের পাপস্ক্ষালন হল তাঁর নবজন্মের অন্ন ও জলদানের মতো পুণ্য কর্মে। সত্যযুগের শুরু অক্ষয় তৃতীয়ায়। কৃষিপ্রধান দেশ ভারতবর্ষে অক্ষয় তৃতীয়ার দিনটিতে ধরিত্রীদেবীর পুজো অনেক জায়গাতেই উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে পালন করা হয়। অক্ষয় তৃতীয়ার অক্ষয় মাহাত্ম্য। দ্বাপর যুগের কথা। বাল্যসখা শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা করতে বৃন্দাবন থেকে সুদূর দ্বারকায় এলেন সুদামা। দরিদ্র ব্রাহ্মণ প্রিয়তম সখার জন্য কাপড়ের পুটুলিতে বেঁধে এনেছেন তিনমুঠো তণ্ডুল। সেই তণ্ডুল পরম তৃপ্তিতে গ্রহণ করলেন অন্তর্যামী কৃষ্ণ। সুদামা তাঁর দারিদ্রের কথা বলতে পারলেন না। কৃষ্ণের অজানা কিছু নয়। সুদামা ফিরে এলেন বৃন্দাবনে। কিন্তু একী! কোথায় তাঁর পর্ণকুটির! সেখানে যে এক সুরম্য বাসগৃহ। আর সেই বাসগৃহে রয়েছেন স্ত্রী বসুন্ধরা ও সন্তানরা। পৌরাণিক কাহিনি অনুযায়ী অক্ষয় তৃতীয়ার দিনটিতেই সুদামার দারিদ্র দূর করে তাঁকে উপহারস্বরূপ অঢেল সম্পদ দান করেন কৃষ্ণ।
২৩ বৈশাখ, মঙ্গলবার অক্ষয় তৃতীয়া। ইংরেজির ৭ মে। অক্ষয় তৃতীয়ার ব্রতপালন। মহাসমারোহে মহাপর্ব উদযাপন। বিভিন্ন হিন্দুশাস্ত্রের শুক্লা তৃতীয়ার এই দিনটির অশেষ পবিত্রতার কথা বলা হয়েছে। ‘অক্ষয়’ শব্দের অর্থ যার কোনও ক্ষয় নেই। জ্যোতিষ শাস্ত্র অনুযায়ী এই তৃতীয়া তিথি ক্ষয়হীন। অর্থাৎ যার ফল কখনও নষ্ট হয় না। তাই এমনই দিনে দান ও স্নানের (বিশেষ করে গঙ্গাস্নান) মাহাত্ম্য অসীম। যে কোনও শুভ কাজের আদর্শ দিন অক্ষয় তৃতীয়া। হাজার-হাজার বছর ধরে এই দিনের গুরুত্ব অপরিসীম। এদিন পুজোপার্বণ, যজ্ঞ, যপতপ সমস্ত কর্মের ফল অনন্ত ও অক্ষয় হয়। জাতিধর্ম নির্বিশেষে জলদান ও অন্নদান অক্ষয় তৃতীয়ার অন্যতম অঙ্গীকার। শাস্ত্র অনুযায়ী অক্ষয় তৃতীয়া যদি সোমবার অথবা বুধবার হয় এবং এর সঙ্গে রোহিণী নক্ষত্র যুক্ত হলে সেই অক্ষয় তৃতীয়া তিথি শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হয়। উল্লেখ্য, জ্যোতিষীদের মতে ১৬ বছর বাদে এই বছরের অক্ষয় তৃতীয়ায় এক অদ্ভুত সংযোগ ঘটতে চলেছে। যা বিশেষ মঙ্গলদায়ক। সূর্য, শুক্র, চন্দ্র ও রাহু একই উচ্চরাশিতে অবস্থান করবে। ২০০৩ সালে এরকমই পাঁচটি গ্রহের সংযোগ ঘটেছিল। অক্ষয় তৃতীয়ার দিন সূর্য মেষ রাশিতে এবং চন্দ্র বৃষ রাশিতে থাকে। সূর্য, চন্দ্র ও বৃহস্পতি একজোট হয়ে চলে।
অক্ষয় তৃতীয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্য শুরুর আলাদা গুরুত্ব ক্রেতা ও বিক্রেতার সম্পর্ক স্থাপন। হালখাতা যাঁরা নতুন কিছু শুরু করতে চান অক্ষয় তৃতীয়ার থেকে শুভ দিন কিছু নয়। এদিন দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে সিদ্ধিদাতা গণেশ ও ধন-সম্পদের দেবী মা লক্ষ্মীর পুজো অত্যন্ত ভক্তিভরে করা হয়। দেবপ্রতিষ্ঠা, বিবাহ, মুণ্ডন সংস্কার, গৃহপ্রবেশ, সম্পত্তি ক্রয়, গৃহনির্মাণ, পিতৃপুরুষের পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম ও তর্পণ প্রভৃতি নানা ধরনের শুভ কাজের ক্ষেত্রে অক্ষয় তৃতীয়ার দিনটির কোনও বিকল্প নেই। এদিন অনেকেই সোনা কেনেন। এদিনই মা লক্ষ্মীর আরাধনা করে অটুট ধন-সম্পত্তির অধিকারী হন ধনের দেবতা কুবের। পৌরাণিক কথা অনুসারে শ্রীকৃষ্ণের কাছে অক্ষয় তৃতীয়ার মাহাত্ম্য জানতে চাইলেন রাজা যুধিষ্ঠির। এর উত্তরে কৃষ্ণ শুধু একটি বাক্যই প্রয়োগ করলেন-প্রথম পাণ্ডব, জেনে রাখুন এই দিনের মাহাত্ম্য অনন্ত। সূর্য ভগবান বনবাসের সময় যুধিষ্ঠিরকে অক্ষয় পাত্র দান করেন। আর এই অক্ষয় তৃতীয়ার দিনই দ্রৌপদীর লজ্জা নিবারণ করেন কৃষ্ণ। মহাভারতের রচনা শুরু এদিন। মহর্ষি বেদব্যাস বলছেন, গণেশ লিখে চলেছেন। একই আধারে কাব্য, পুরাণ ও ইতিহাস হল এই মহাগ্রন্থ। এজন্যই মহাভারত মহাকাব্য। পঞ্চম বেদ হিসেবে স্বীকৃত। মহাভারত নামক এই সুবৃহৎ ইতিহাস প্রদীপেরই মতো মোহের অন্ধকার দূর করে মানুষের মনোলোককে জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত করে। ‘ইতিহাস-প্রদীপেন মোহাবরণঘাতিনা৷ / লোকগর্ভগৃহং কৃৎস্নং যথাবৎ সম্প্রকাশিতম্।।’
ভগবান বিষ্ণু এবং মা লক্ষ্মীর পুজো অক্ষয় তৃতীয়ায় বিশেষ ফলবতী হয়। স্নানের পর হলুদ বস্ত্র পরে ঠাকুরঘরে বিষ্ণু ও লক্ষ্মীকে গঙ্গাজলে স্নান করিয়ে পুজোর্চনার আয়োজন করা কর্তব্য। বিষ্ণুর প্রিয় তুলসীপাতা বিনা স্নানে তোলা অনুচিত। লক্ষ্মীদেবী নারাজ হন। তুলসী ও হলুদ ফুলের মালা পরিয়ে হলুদ আসনে বসে উত্তরদিকে মুখ করে একাগ্রচিত্তে বিষ্ণুর আরাধনা ও বিষ্ণুপুজো। ‘ওঁ নমো নারায়ণায় নমহ।’ বারংবার বিষ্ণু নাম উচ্চারণ। এরপর লক্ষ্মীপুজো। ‘ওঁ শ্রী নমহ’-শ্রীযন্ত্রের পুজো। ধূপ-দীপ প্রজ্জ্বলন ও ধ্যান। পুজোর সময় অনে্যর অনিষ্ট চিন্তা করা অনুচিত। এতে পুজোর মূল উদ্দেশ্যেই ব্যাহত হয়। বিষ্ণুসহস্রনাম এবং বিষ্ণুচালিশা পাঠ।বিষ্ণু এবং মা লক্ষ্মীকে ভোগ নিবেদন। যবের ছাতু, জলে ভেজানো ঠান্ডা কাঁকরি ও ভেজা চানার ডাল ভোগ হিসেবে নিবেদন করা হয়। ছানা ও নানারকম মিষ্টান্ন দেওয়া হয়। বৈশাখের এই প্রচণ্ড দাবদাহে ঠান্ডা ভোগই পছন্দ ত্রি-জগৎপতি শঙ্খচক্র গদাধর পীতাম্বর শ্রীহরির। শেষে বিষ্ণু ও লক্ষ্মীর আরতি। ছাতুর প্রসাদ বিতরণ।অক্ষয় তৃতীয়ার সীমাহীন মাহাত্ম্যের কথা স্বল্প কথায় শেষ হওয়ার নয়। পৌরাণিক কাহিনি অনুযায়ী এদিন ভগবান নরনারায়ণ, শ্রীশ্রী হয়গ্রীব মাধব, শ্রীশ্রীধূমাবতীদেবী এবং শ্রীশ্রীপরশুরামের আবির্ভাব এই ভূমণ্ডলে। তাই বিষ্ণুর দশাবতারের অন্যতম শ্রীশ্রীপরশুরাম ও দশমহাবিদ্যার অন্যতম শ্রীশ্রীধূমাবতীদেবীর পুজো অনেকেই করেন। অক্ষয় তৃতীয়ায় মা গঙ্গার মর্তে অবতরণ। এদিন শিব, গঙ্গা, কৈলাস, হিমালয় ও ভগীরথের পুজোও হয়। গলায় লাল ধাগা, সিঁথিতে সিঁদুর। বিবাহিত মহিলারা এদিন শিবমন্দিরে স্বামীদের দীর্ঘায়ু কামনা করে কায়মনোবাকে্য পুজো করেন।
অক্ষয় তৃতীয়ায় পুরীধামে জগন্নাথদেবের ২১ দিনব্যাপী চন্দনযাত্রার শুরু। জগন্নাথদেবের রথনির্মাণের শুরু হয় এদিন। শেষ হয় আষাঢ়ের শুক্লা দ্বিতীয়ার আগে। অর্থাৎ রথযাত্রার একদিন আগে। তার আগে যথাবিহিত পুজো। শ্রীমন্দির (পুরীর জগন্নাথদেবের মন্দির) থেকে জগন্নাথ, বলভদ্র এবং সুভদ্রার তিনটি আজ্ঞামাল্য (আজ্ঞামালা) বহন করে আনেন তিনজন পান্ডা। রথ নির্মাণ শুরু হোক–জগন্নাথদেবের এই নির্দেশ আজ্ঞামালার মাধ্যমে পৌঁছে যায় পুজোস্থলে। জগন্নাথদেবের চন্দনযাত্রা এসে থামে যেখানে রথ নির্মাণের কাজ শুরু হয় সেই জায়গায়। এরপর রথ নির্মাণের প্রথম ধাপ শুরু হয়। জগন্নাথদেবের আচার-আচরণ একজন সাধারণ মানুষের মতোই কল্পনা করা হয়। গরমের সময় পুকুর অথবা নদীর ঠান্ডা হাওয়ায় আমাদের যেমন আরামবোধ হয়, তেমনই জগন্নাথ মহাপ্রভু নরেন্দ্র সরোবরে হাওয়া খেতে যান। এই সরোবরে তাঁর চন্দনযাত্রা উৎসব খুব ধুমধাম করে পালিত হয়। জগন্নাথদেবের উৎসব মূর্তির শ্রীঅঙ্গে চন্দনের প্রলেপ পড়ে। অত্যাধিক গরমে শ্রীঅঙ্গে চন্দনের প্রলেপে আরাম হয়। নারকেল গাছ ও অন্য গাছ-গাছালিতে ঘেরা নরেন্দ্র সরোবরের সুশীতল জলে সুসজ্জিত ময়ূরপঙ্খী নৌকা। জগন্নাথদেবের নৌ-বিহার দেখতে বহু ভক্তের সমাগম হয় সরোবরের চারদিকে। সরোবরের মাঝখানে সুদৃশ্য মন্দিরে জগন্নাথদেব, বলভদ্র ও সুভদ্রার উৎসব মূর্তির প্রতিদিন পুজোর্চনা হয়। নবদ্বীপধামে শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর চন্দনযাত্রা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। কলকাতা সহ গৌড়ীয় মঠের বিভিন্ন শাখায় তিন সপ্তাহব্যাপী চন্দনযাত্রা উৎসবে ভক্তের ভিড় দেখার মতো। যিনি ভগবান বিষ্ণু তিনিই প্রভু জগন্নাথ, আবার তিনিই করুণাময় শ্রীকৃষ্ণ। অক্ষয় তৃতীয়ায় কৃষ্ণমূর্তিতে চন্দন লেপন অত্যন্ত শুভ বলে মনে করা হয়। শ্রীশ্রীরামঠাকুরের তিরোধান অক্ষয় তৃতীয়ায়। এদিন তাঁর বিভিন্ন মঠ ও মন্দিরে তিরোধান স্মরণোৎসব।
কেদারনাথ, বদ্রীনাথ, গঙ্গোত্রী ও যমুনোত্রী- এই চারধাম যাত্রা শুরু হয় অক্ষয় তৃতীয়ায়। প্রতি বছরের মতো এবারেও গঙ্গোত্রী ও যমুনোত্রী দু’টি মন্দির খুলবে অক্ষয় তৃতীয়ার পবিত্র দিনটিতে। কেদারনাথ এবং বদ্রীনাথ মন্দির সাধারণত সেদিনই খোলে। তবে এই বছর অক্ষয় তৃতীয়ার একদিন পর অর্থাৎ ৯ মে মন্দির দু’টির দ্বার উন্মুক্ত হবে বলে মহাশিবরাত্রির দিন ঘোষণা করেছে ‘কেদারনাথ-বদ্রীনাথ মন্দির সমিতি।’ বৈশাখের শুক্লা পঞ্চমীর পুণ্য তিথিতে আদিগুরু শ্রীশঙ্করাচার্য জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মতিথিতে মন্দির দু’টির কপাট উন্মোচন বিশেষ ঘটনা বইকি! শ্রদ্ধার সঙ্গে যে কোনও দান সে তো সমাজসেবারই নামান্তর। অক্ষয় তৃতীয়ার মাহাত্ম্য সমাজসেবার সুগভীরেও নিহিত আছে।