কার্তিক মাসের পূর্ণিমার তিথিকে বলা হয় রাস পূর্ণিমা। হিন্দু ধর্মে এই তিথির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এই দিন মা লক্ষ্মীর পুজোর জন্য খুব বিশেষ। এই বছর ১৫ নভেম্বর পড়েছে রাস পূর্ণিমা। সেইসঙ্গে এই দিন শুক্রবার যা মা লক্ষ্মীর দিন বলা হয়। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে এই দিন শ্রীকৃষ্ণ ও রাধারানী গোপিনীদের সঙ্গে লীলাখেলায় মেতে ওঠেন। ঈশ্বরের সঙ্গে আত্মার মিলনই হলো রাস।
বলা হয় যে কৃষ্ণের সংসর্গে এসে গোপিনীদের মধ্যে অহংকার তৈরি হয়েছিল। গোপিনীরা যাতে নিজেদের ভুল বুঝতে পারে তার জন্য কৃষ্ণ অন্তর্ধান হয়েছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ তাদের অহংকার মুক্ত করার জন্য অন্তর্ধান হয়েছিলেন। গোপিনীরা তাদের ভুল বুঝতে পারে এবং শ্রীকৃষ্ণ গোপিনীদের মনুষ্য জীবনের পরম সত্য বুঝিয়ে তাদের অন্তরের আত্মাকে শুদ্ধ করে তোলেন। তাদের সকল মনোবাঞ্ছা পূরণ করেন। তাদের এই জগতের মোহ মায়া থেকে মুক্ত করেন।
রাস পূর্ণিমার এই লগ্নে রাজ্যের বিভিন্ন এলাকার সঙ্গে সমারোহে পালিত হচ্ছে বাঁকুড়ার ছাগুলিয়ার রায় পরিবারে। গত দেড়শো বছর ধরে কয়েক পুরুষ ধরে চলছে এই পুজো। এই পরিবারের প্রবীণ ফকীর চন্দ্র রাযের আমলে শুরু হয় এই পুজো। এই পরিবারে ঠাকুর দামোদর চন্দ্র নামে পূজিত হন শ্রীকৃষ্ণ। রাস পূর্ণিমার দুদিন ধরে এই পুজো দেখতে এলাকার কয়েক হাজার মানুষ জড়ো হন। মন্দির চত্বর সাজিয়ে ফেলা হয় ফুলে। ঠাকুরের জন্য নানান পদে ভোগ রান্না হয় সেখানে।

রাসের তাৎপর্য কী (Rash Purnima 2024)?
প্রেমভাব বৈষ্ণব ভাবনার একটি প্রধান ভাব। রাস শব্দ এসেছে রস থেকে। রসের বিরাট ব্যাপ্তি। আনন্দ আস্বাদনই মূল কথা রাসের। বৈষ্ণব রসশাস্ত্রে পঞ্চম রস, শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য মধুর রস সম্পর্কে বিস্তৃত ভাবে বলা হয়েছে। বৃন্দাবনদাসের ‘শ্রীশ্রীচৈতন্যভাগবত’ এবং কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’-কাব্যে বিস্তৃত আলোচনা করা হয়েছে রস বা লীলা সম্পর্কে। রাস মানেই মিলন (Rash Purnima 2024)। কৃষ্ণ (Radha-Krishna) প্রেমের ক্ষুদ্র আত্মা পরমাত্মায় মিলনের বাসনাই রাসের মূল ভরকেন্দ্র। পূর্ণ অবতার ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মহাভাবের একমাত্র অধিকারিণী শ্রীরাধারানি। কৃষ্ণ হলেন জগতের আসল পুরুষ, বাকি মানবসামজ প্রকৃতিতুল্য। তাই সকল গোপিনী এবং নরনারী রাধাভাব বা মঞ্জরী ভাবনায় ভাবিত হন। এই পরম জ্ঞানের কথা জানানোর জন্যই কৃষ্ণের বৃহৎ লীলা বা রাসের প্রকাশ।
মুক্তির পথ দেখান কৃষ্ণস্বরূপ জ্ঞান
কৃষ্ণপ্রেমে মুগ্ধ হয়ে গোপিনীরা সংসার ত্যাগ করে বৃন্দাবনে চলে যান। সেখানে গিয়ে সকলে কৃষ্ণপ্রেমে সমবেত হন। শ্রীকৃষ্ণ তাঁদের সংসারে ফিরে যেতে অনুরোধ করেন। কিন্তু গোপিনীরা মানতে অস্বীকার করেন। শ্রীকৃষ্ণ তাঁদের এই ভাবনায় মনে অহংকার ভাব এলে রাধাকে নিয়ে চলে যান। পরে গোপিনীরা নিজেদের ভুল বুঝতে পারেন। অহংকার ভুলে গিয়ে কৃষ্ণপ্রেমে স্তব পাঠ শুরু করেন। এদিকে তাঁদের স্তবে কৃষ্ণ সন্তুষ্ট হলে কৃষ্ণ ফিরে আসেন। এরপর গোপিনীদের জীবন সম্পর্কে গভীর তত্ত্বকথার উপদেশ দেন। প্রত্যক গোপিনীর মনোবাঞ্ছা পূরণ করে জাগতিক দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্তির পথ দর্শান। এই কৃষ্ণ (Rash Purnima 2024) হলেন প্রকৃত জ্ঞানের আধার। আর জগতস্বরূপ জ্ঞান হলেন স্বয়ং রাধা। সকল গোপিনীরা হলেন রাধা (Radha-Krishna) শক্তির প্রকাশ মাত্র।
নাম-সংকীর্তন এবং নগর পরিক্রমা
এই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের রাস (Rash Purnima 2024) বাংলা, মথুরা, বৃন্দাবন, ওড়িশা, অসম, মণিপুর, পূর্ববঙ্গের বেশ কিছু জায়গায় ব্যাপক ভাবে দেখা যায়। তবে মূল আরাধ্য রাধাকৃষ্ণ হলেও অঞ্চল ভেদে বিভিন্ন দেবদেবীর পুজো করতে দেখা যায়। যেমন-কোচবিহারের মদনমোহন মন্দিরে রাস হয় এবং এক মাস মেলা বসে এখানে। এই মেলা বিরাট বিখ্যাত। এখানে রাসে দুর্গাপুজো, কালীপুজোও করতে দেখা যায়। আবার নবদ্বীপ, শান্তিপুর, ফুলিয়া, বর্ধমানের বেশ কিছু বৈষ্ণবপাট বাড়ি, সমাজবাড়ি এবং আখড়ায় মাটির মূর্তিতে রাধাকৃষ্ণের পুজো হয়। গৌর-নিতাই, পঞ্চতত্ত্বের নামে চলে নাম-সংকীর্তন এবং নগর পরিক্রমা। শ্রীচৈতন্যের স্মৃতি বিজড়িত জায়াগায় পালন হয় বিশেষ পুজো। কীর্তন, পদাবলী, পালাগান এবং রাসের সখীদের অষ্টকলা প্রদর্শন মূল আকর্ষণ থাকে।