প্রতি বছর শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমায় পালিত হয় রাখী বন্ধন, হিন্দু ধর্মে ভাই বোনের ভালবাসার প্রতীক এই উৎসব। এই পবিত্র দিনে বোন ভাইকে রাখী বেঁধে দেয় এবং ভাই বোনকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দেয়। ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে, শুভ সময়ে রাখী বাঁধার অনেক গুরুত্ব রয়েছে। জ্যোতিষ শাস্ত্র অনুসারে, বিষ্টিভদ্রার সময় রাখি বাঁধা উচিত নয়। রাখির দিন ভাইদের খুব যত্ন নেওয়া হয়।২০২২ সালে রাখী বন্ধন কবে? এই বছর রাখী বন্ধন পালিত হবে ১১ আগস্ট ২০২২, বৃহস্পতিবার।
রাখী বন্ধনের শুভ সময়-
শ্রাবণ শুক্লা পূর্ণিমা ১১ আগস্ট সকাল ১০.৩৮ থেকে শুরু হবে এবং ১২ আগস্ট সকাল ০৭.০৫ পর্যন্ত চলবে। ১১ আগস্ট, রাখির শুভ সময় সকাল ০৯.২৮ থেকে রাত ০৯.১৪ পর্যন্ত হবে।
অভিজিৎ মুহুর্তেও রাখী বাঁধা যায়-
১১ আগস্ট, অভিজিৎ মুহুর্তা ১২.০৬ টা থেকে ১২.৫৭ টা পর্যন্ত হবে। অমৃতকাল ০৬.৫৫ টা থেকে ০৮.২০ টা পর্যন্ত চলবে। ব্রাহ্ম মুহুর্ত হবে ভোর ০৪.২৯ থেকে ০৫.১৭ পর্যন্ত।
রাখী বাঁধার পদ্ধতি-
ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে, রাখী বাঁধার সময় ভাইয়ের মুখ পূর্ব দিকে এবং বোনের মুখ পশ্চিম দিকে হওয়া উচিত।
বোনেরা তাদের ভাইকে চাল সিঁদুরের টিকা লাগান।
ঘিয়ের প্রদীপ দিয়ে আরতি করেন, তারপর মিষ্টি খাওয়ানোর পর ভাইয়ের ডান হাতের কব্জিতে রাখি বেঁধে দেন।
রাখী বন্ধন কি?
Raksha Bandhan রাখী বন্ধন ভারতের একটি জনপ্রিয় উৎসব। এই উৎসব হলো ভাই ও বোনের উৎসব। রাখী বন্ধনের দিন দাদা বা ভাইয়ের হাতে দিদি বা বোনেরা রাখী পরিয়ে দেয়।
রাখি বন্ধন উৎসব হিন্দু ধর্ম, জৈন ধর্ম ও শিখ সম্প্রদায়ের মধ্যে পালন করা হয়। ইসলাম ধর্মের অনেক ভাই-বোন এই উৎসব পালন করে থাকে।
ভাই ও বোনেরা কেন রাখী বন্ধন উৎসব পালন করে?
রাখী কেবলমাত্র একটি সূতো নয়। রাখী পরানোর মাধ্যমে দিদি বা বোনেরা ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে এবং ঈশ্বরের কাছে তাদের মঙ্গল কামনা করে।
অপরদিকে ভাইয়েরা দিদি বা বোনের কাছে রাখি পড়ার সময় তাদের আজীবন রক্ষা করার শপথ নেয়।
রাখী বন্ধন (Raksha Bandhan) উৎসব কখন পালন করা হয়?
ভারতবর্ষে এই উৎসব শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমার দিন পালন করা হয়। এজন্য অনেক সময় রাখী বন্ধন উৎসব কে রাখী পূর্ণিমা ও বলা হয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রাখী বন্ধন (Raksha Bandhan)
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ করার জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রাখী বন্ধন (Raksha Bandhan) উৎসব পালন করেছিলেন।
তিনি কলকাতা, ঢাকা ও সিলেট থেকে হাজার হাজার হিন্দু ও মুসলিম ভাই ও বোন কে আহ্বান করেছিলেন একতার প্রতীক হিসাবে রাখি বন্ধন উৎসব পালন করার জন্য।
সেই সময় দেশে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা চরম পর্যায়ে ছিল। আমরা আজ ১৫ ই আগস্ট ২০১৯ সালে রাখী বন্ধন উৎসব পালন করছি। কিন্তু ১০০ বছরেরও বেশি সময় আগে হিন্দু ও মুসলিম এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে একতা আনার জন্য রাখী বন্ধন উৎসব পালন করা হয়েছিল।
উনিশ শতকে আমাদের বাংলায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন চরম পর্যায়ে ছিল যা ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কাছে অপরিমিত ভয়ের কারণ। এই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দমন করার জন্য ব্রিটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নেয় তারা বাংলাকে দুই ভাগে ভাগ করবে। সেই সময় রবীন্দ্রনাথ সহ গোটা ভারতের বিভিন্ন নেতা এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছিল এবং বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে।
১৯০৫ সালের জুন মাসে লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয় এবং ১৯০৫ সালের আগস্ট মাসে বঙ্গভঙ্গ জন্য আইন পাশ করা হয়। এই আইন কার্যকরী হয় ১৬ ই অক্টোবর, ১৯০৫।
শ্রাবণ মাসে হিন্দু ভাইবোনদের মধ্যে রাখী বন্ধন উৎসব পালন করা হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বোধ জাগিয়ে তোলা এবং ব্রিটিশদের বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য সবাইকে রাখী বন্ধন উৎসব পালন করার জন্য আহ্বান করেন।
ইতিহাসে রাখী বন্ধন এর প্রমাণ
কৃষ্ণ ও দ্রৌপদী
মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণর হাতে আঘাত লেগে রক্তপাত হলে দ্রৌপদী তার হাতে কাপড় বেঁধে দেয়। তখন তিনি দ্রৌপদীকে নিজের বোন হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে তাকে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেয়। পরে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ এর সময় কৃষ্ণ দ্রৌপদীর সম্মান রক্ষা করে তার প্রতিদান দেয়।
রানী কর্ণবতী ও সম্রাট হুমায়ুন
১৫৩৫ সালে গুজরাটের সুলতান বাদশা চিতোর আক্রমণ করলে চিতোরের রানী কর্ণবতী হুমায়ুনের সাহায্য প্রার্থনা করেন এবং তার কাছে একটি রাখী পাঠান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হুমায়ুন চিতোর রক্ষা করতে পারেননি কারণ তিনি চিতোর পৌঁছানোর আগেই বাহাদুর শাহ চিতোর জয় করে নিয়েছিলেন। বিধবা রানী কর্ণবতী নিজেকে রক্ষা করতে না পেরে এবং বাহাদুর শাহ এর হাত থেকে বাঁচার জন্য ১৩০০০ স্ত্রীকে নিয়ে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে জহর ব্রত পালন করেন। পরে হুমায়ুন চিতোর জয় করে কর্ণবতির ছেলে বিক্রম সিংহ কে রাজা ঘোষণা করেন।
বর্তমান সময়ে আমরা সবাই রাখী বন্ধন উৎসবে মেতে উঠি। কিন্তু অনেক সময় তা উৎসব হয়েই থেকে যায়। অনেক সময় দামী ও রংচঙে রাখীর নিচে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে রাখি বন্ধন এর সেই পুরোনো গৌরব।