গণেশের জন্ম কাহিনী
পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, নন্দী দেবী পার্বতীর সমস্ত আদেশ মেনে চলেন। একবার তিনি ভেবেছিলেন যে মাকে কিছু তৈরি করে দেওয়া উচিত, যা কেবল মা-এর আদেশ পালন করবে। এমন পরিস্থিতিতে তিনি একটি শিশুর আকার তৈরি করেছিলেন এবং তাঁতে জীবন দান করেছিলেন।
কথিত আছে যে, মাতা পার্বতী যখন স্নান করছিলেন, তখন তিনি শিশুটিকে বাইরে থেকে দ্বার রক্ষা করতে বললেন। মাতা পার্বতী শিশুটিকে নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, তাঁর অনুমতি ব্যতীত কেউ যেন ভিতরে প্রবেশ না করে। এমন সময় ভগবান শিব পার্বতীর সঙ্গে দেখা করতে এলে গণেশ তাঁকে ভিতরে যেতে বাধা দেয়।
এতে ভগবান শিব (Siv) ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন এবং তিনি অজান্তেই সেই শিশুটির মাথা দেহ থেকে আলাদা করেন। মাতা পার্বতী যখন বাইরে এলেন, সমস্ত কিছু দেখে তিনি রেগে গেলেন। তিনি তাঁর বাচ্চাকে বাঁচতে আদেশ দেন মহাদেব-কে। এর পরেই মানুষের বদলে হস্তির মাথা দান করে পুনরায় জীবন ফিরিয়ে দেওয়া হয় ওই শিশুটির দেহে। এর পর থেকেই গজানন (Gajanan) নামে পরিচিতি পান তিনি। দেবাদিদেব মহাদেবের আশির্বাদে তিনি প্রথম দেবতা রূপে স্বীকৃতি পান। এই সময় যে সমস্ত দেবতারা গণেশ-কে অনেক বর দিয়েছিলেন। সেই সমস্ত গণের অধিপতি হওয়ার কারণে গণেশকে গণপতি বলা হয়।
যাঁর নাদা পেট আর গাদা গাদা খাওয়া নিয়ে ছেলেরা ছড়া কাটে সেই গণেশ ঠাকুরের জন্মদিন ভাদ্রমাসের শুক্লা চতুর্থী। উড়িষ্যা আর দক্ষিণ ভারতে তাঁর বিশেষ উৎসব, তবে মহারাষ্ট্রের মতো কোথাও নয়। সেখানে গণপতি বাপ্পা মোরিয়ার খাতিরে সমারোহ চলবে দশ দিন।
গণেশ সিদ্ধিদাতা। ভারত ভূখণ্ডে তাঁকে আগে স্মরণ করে তবে শুভকাজ শুরু হয়। সমস্ত মন্দিরের প্রবেশদ্বারে তাঁর মূর্তি। সব দেবতার আগে তাঁর পুজো। মঙ্গল কাব্যের কবিরা সবাই তাঁকে স্মরণ করে লেখনী ধরেছেন। তিনি যে মহাভারতের লিপিকর। গণেশের খ্যাতি দেশের সীমানা ছাড়িয়ে নেপাল, ভুটান, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, জাভা, বোর্নিও, বালিদ্বীপে বিস্তৃত। চীনদেশে তিনি শো-তেন, জাপানে কঙ্গি-তেন। তিনি আছেন জৈন দেবায়তনে। বৌদ্ধ গণেশের মূর্তি ভয়ংকর। কেন কে জানে!
গণেশের (ganesh) হস্তীমুণ্ডের রহস্যের সূত্র ধরিয়ে দিয়েছিলেন ‘মহাভারত’ খ্যাত (Mahavarat) পিটার ব্রুক আর জঁ ক্লদ ক্যরিয়ার। তাঁদের ছবিতে গণেশ এক ছৌ-নাচের মুখোশ পরা কিশোর। কৌল চিহ্ন। ঠিক মহেঞ্জোদাড়োর পশুপতি মূর্তির শিং জোড়ার মতো। পুরাণের যুগে যখন বৈদিক দেবতারা ভারতের নানা প্রান্তে পুজো পাওয়া গ্রাম দেবতা ও গণনায়কদের পথ করে দিচ্ছেন, তখন গণেশের প্রবেশ। তিনি শিব ও পার্বতীর গ্রহণ করা পুত্র, তাই তাঁর জন্ম ও হস্তীমুণ্ড নিয়ে কত না বিচিত্র কাহিনি।
আকাশ রক্ষা করবেন শিব। তাঁর প্রসন্ন হাসি থেকে জন্ম নিল এক কুমার। তার অপরূপ রূপ দেখে পার্বতীসহ সবাই মুগ্ধ। অবহেলিত শিব রাগ করে বালককে হস্তীমুণ্ড লম্বোদর বানিয়ে দিলেন। আর এক গল্পে দেখা গেল পার্বতী গাত্রমল নিয়ে এক শিশু গড়ছেন। মাথার মাটি কম পড়েছে। স্কন্দ এক পাগলা হাতির মাথা কেটে বসিয়ে দিয়েছেন। পার্বতীর কাপড়ের আঁচল দিয়ে এক পুতুল গড়ে প্রাণ দিয়েছেন শিব। কিন্তু বারবার তার মাথা খসে যায়। ইন্দ্রের ঐরাবতের মাথা জুড়ে সে শিশুকে বাঁচান হল। বিষ্ণুর কৃপায় পার্বতীর এক পুত্র হল, কিন্তু শনির দৃষ্টি পড়ায় মুণ্ডলোপ হল তার। সেখানে বসল হাতির মাথা।
জাপানের গল্প আর এক রকম। সেখানে শিবের সন্তান কঙ্গি-চেন আর বিনায়ক মিলে জোড়া গণেশ। সম্ভবত কার্তিক আর গণেশ। পরের গল্পটা সবাই জানেন। শিব ঠাকুর হুটহাট ঢুকে পড়েন পার্বতীর ঘরে। বিরক্ত পার্বতী গাত্রমল দিয়ে বালকবীর গণেশকে বানিয়ে স্নানাগারের প্রহরায় রেখে দিলেন। খানিক বাদে শিব এসে বাধা পেলেন বালকের কাছে। লাগল ভয়ানক যুদ্ধ। শেষে শিবের ত্রিশূলের খোঁচায় বালকের মুণ্ডচ্ছেদ হয়ে গেল। শোকগ্রস্ত পার্বতীর শাপে সৃষ্টি হল বিপন্ন।
তাঁকে শান্ত করতে শিব নতুন মুণ্ডের খোঁজে বের হলেন। উত্তরদিকে মাথা করে শুয়ে ছিল এক হাতি। তার মুণ্ড এনে বসিয়ে দেওয়া হল। দেবতারা আশীর্বাদ করলেন সব দেবতার আগে গণেশের পূজা হবে। গণপতি গণেশ হবেন শিবের অনুচরবাহিনী গণ বা বিনায়কদের সেনাপতি। বিনায়কদের অন্য নাম প্রমথ। তারা সকলেই খর্বকায়, স্থূলতনু, প্রলম্বজঠর। কারও ষাঁড়ের, কেউ বা বাজপাখির মতো মুখ, কেউ বা ঘোড়ামুখো হয়গ্রীব। গণপতি কখনও বিঘ্নরাজ বিনায়ক। আবার বিঘ্নবিনাশকও। স্মরণ না করলে বিভ্রাট, করলে সিদ্ধিলাভ। তাই তিনি সিদ্ধিদাতা।
গণেশের নানা রূপ। জটামুকুট, ত্রিনয়ন, নাগ উপবীত প্রভৃতি লক্ষণ হল শিবের চিহ্ন। পরশুরামের সঙ্গে লড়াইয়ের সময় কুঠারের আঘাতে একটা দাঁত হারিয়ে একদন্ত। গণেশের বাহন মূষিক। পিতার বাহন বৃষের ক্ষুদ্র রূপ। মূষিক শস্যবিনাশকারী। হয়তো শিবের ধ্বংসকারী রূপের প্রতীক। আবার ইঁদুর মাটি খুঁড়ে উর্বরতা বাড়ায় এবং সমৃদ্ধি আনে। গণেশ ভীষণ গন্ধপ্রিয়। চোর শব্দের এক অর্থ হল এক ধরনের গন্ধ। এই কারণেও হয়তো তিনি চৌর-গণেশ।
গণেশ স্থূলতনু। ঠিক যেন কুবেরের প্রতিরূপ। গণেশ সিদ্ধিদাতা। সিদ্ধির জন্য লাগে ধনের মহিমা। গণেশ কি কোনও প্রাচীন যক্ষ যাঁকে পার্বতী ভালোবেসে সন্তান বলে মেনে নিয়েছিলেন?
গণেশ ঠাকুরের গায়ের বর্ণটি টুকটুকে লাল। যেন আদিম কোনও সূর্যদেবতা। আবার যোদ্ধারূপের প্রতীক গণেশ হলেন রক্তবর্ণ। পার্বতীর আদরের পুত্রটি বড় মোদকপ্রিয়। তাঁর তুষ্টির জন্য মোদক জাতেরই সৃষ্টি হয়ে গেল। শুঁড় বাড়িয়ে মোদক তুলছেন তিনি। লিপিকর, তাই ব্যাসদেব তাঁর শরণাপন্ন হন মহাভারতের শ্লোককে আখরের বাঁধনে ধরে রাখার জন্য।
গণেশের যে কত নাম। তিনি দ্বৈমাতুর, বিনায়ক, গণাধীশ, বিঘ্নেশ, প্রমথাধিপ, বীজগণপতি, হেরম্ব, বক্রতুণ্ড, বাল গণপতি, ভক্তবিঘ্নেশ, বীরবিঘ্নেশ, শক্তিগণেশ, ধ্বজগণাধীপ, পিঙ্গলগণপতি, উচ্ছিষ্টগণপতি, বিঘ্নরাজ গণপতি, লক্ষ্মী গণেশ, মহা গণেশ, ভুবনেশ গণপতি, নৃত্য গণপতি, উর্ধ্বগণেশ, প্রসন্ন গণেশ, উন্মত্ত বিনায়ক আর হরিদ্রা গণেশ। গণেশের স্ত্রী সিদ্ধি আর বুদ্ধি। বৈনায়কী নামেও এক শক্তির সন্ধান আছে। গণেশের যে কত আদরের নাম আছে তার ঠিক নেই।
গণেশের মূর্তি হয় স্থানক, আসন এবং নৃত্যরত। হাতে থাকে মোদকভাণ্ড, পরশু, অক্ষমালা, অঙ্কুশ, পাশ, দণ্ড, পুস্তক, শূল, সর্প, নীলোৎপল, ধনুঃ, শর, পুথি, অক্ষমালা ইত্যাদি। হেরম্ব গণপতির পঞ্চমুখ, বাহন সিংহ।
গুপ্তযুগের পর থেকে প্রাচীন এই ঠাকুর গাণপত্য নামের সম্প্রদায়ের উপাস্য হলেন। গাণপত্যরাও ক্রমে ছ’টি শাখায় ভাগ হয়ে যান।
চিরন্তন গণেশ চতুর্থী বা বিনায়ক চতুর্থী বিশেষ উৎসবের মর্যাদা পেতে লাগল শিবাজী মহারাজের (১৬৩০-৮০) উদ্যোগে। মোগল আক্রমণে অস্থির মহারাষ্ট্র গণেশ চতুর্থী পালন করে উদ্দীপিত হল। ১৮৯৩ সালে বালগঙ্গাধর তিলক আবার গণেশ উৎসব জাগিয়ে তুললেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে জনগণকে একত্র করতে। আজও মহারাষ্ট্রে গণপতি বাপ্পা মোরিয়ার যে পূজা হয় তার সমারোহ ও বৈভবের তুলনা মেলা ভার।
বর্ধমান শহরে বাংলা নববর্ষের হাল খাতার দিনে তাঁর বিশেষ খাতির হয়। ইদানীং কয়েক বছরে গণেশ চতুর্থীর আয়োজন চলছে। অবাঙালি প্রভাবের অনুপ্রবেশ বলে মুখ ঘোরাবার ব্যাপার নেই, কারণ এই নাদুসনুদুস ঠাকুরটিকে ভালোবাসেন না এমন মানুষ পাওয়া ভার।
শিবের অনুচরেরা হলেন গণ। সেই গণেরা ক্ষেপে গেলে কী হয় তার সাক্ষী ছাগমুণ্ড দক্ষ। অন্য রকম গণতন্ত্রই এখন চলতি ব্যবস্থা। সেখানে জনগণেশ কখনও বিঘ্নরাজ আর কখনও বা বিঘ্নেশ্বর আকার ধারণ করেন তা ভোটের বাক্স না খোলা পর্যন্ত বোঝা যায় না। তাই গণতন্ত্রে সবাই কিন্তু ভারি সতর্ক।
(Collected from different sources available on books & internet)