www.machinnamasta.in

ওঁ শ্রীং হ্রীং ক্লী গং গণপতয়ে বর বরদ সর্বজনস্ময়ী বশমানয় ঠঃ ঠঃ

May 10, 2025 5:27 am
olaichandi

আজ বর্ধমানের ডিভিসি মোড়ে বহু প্রাচীন মা ওলাইচন্ডীর বছরের পুজো। বিশিষ্ট পুরোহিত নারায়ণ শাত্রীর হাত ধরে মাকে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করা হবে। প্রতি বছর কয়েক হাজার ভক্ত এই মন্দিরে হাজির হন মায়ের কাছে প্রার্থনা নিয়ে। বলির চল রয়েছে। পুজোর শেষ মিলবে মায়ের প্রসাদ। স্থানীয়দের বিশ্বাস, এই দেবী অত্যন্ত জাগ্রত, মা সকলের মনোবাঞ্ছা পূরণ করেন। এই পুজোয় নিরামিষ নৈবেদ্য দেওয়া হয়। শাস্ত্র অনুযায়ী বলা হয়ে থাকে পুজোর পৌরহিত্যে যেকোন‌ও বর্ণ বা সম্প্রদায়ের লোক, এমন কি নারীরও অধিকার আছে। বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির মধ্যে তাঁর পূজা প্রচলিত। ওলাইচণ্ডী বাংলার লোকসংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দেবী।

দেবী দুর্গাকে যে রূপে আমরা অর্চনা করি, তিনি মাতৃস্বরূপা। আবার অন্যদিকে তিনিই চণ্ডী। অসুরদলনী, দশপ্রহরণধারিণী। স্বাভাবিক ভাবেই লৌকিক বিশ্বাসে দেবীর যে বিভিন্ন রূপ দেখা যায়, সেখানেও দেখা মেলে দেবীর এই ‘চন্ডী’-রূপটি। এক নয়, একাধিক লৌকিক দেবীর সঙ্গেই জুড়েছে এই ‘চণ্ডী’ শব্দটি। তবে তার মধ্যে সবথেকে প্রচলিত দেবী ‘ওলাইচণ্ডী’।

লোকবিশ্বাস অনুসারে, ওলাওঠা রোগ তথা কলেরা রোগ নিরাময়ের দেবী ওলাইচণ্ডী (Olaichandi)। আজও এই দেবীর প্রতি ভক্তদের বিশ্বাস এক ইঞ্চিও ভাটা পড়েনি। স্থানীয়দের বিশ্বাস, এই দেবী অত্যন্ত জাগ্রত, মা সকলের মনোবাঞ্ছা পূরণ করেন। এই পুজোয় নিরামিষ নৈবেদ্য দেওয়া হয়। শাস্ত্র অনুযায়ী বলা হয়ে থাকে পুজোর পৌরহিত্যে যেকোন‌ও বর্ণ বা সম্প্রদায়ের লোক, এমন কি নারীরও অধিকার আছে। বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির মধ্যে তাঁর পূজা প্রচলিত। ওলাইচণ্ডী বাংলার লোকসংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দেবী।

লৌকিক দেবতা মানেই সেখানে ধর্মের বাঁধন অনেকটা আলগা। অর্থাৎ কোনও নির্দিষ্ট একটা ধর্মের মানুষই সেই দেবতার আরাধনা করবেন এমনটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হয় না। ওলাইচণ্ডীও এর ব্যতিক্রম নন। পার্থক্যটা স্রেফ নামের। হিন্দু ক্ষেত্রে তিনি ওলাইচণ্ডী আর মুসলিমদের কাছে তিনিই ওলাবিবি। কিন্তু কেন এই নাম?

এককালে ‘কলেরা’-র কোনও ওষুধ ছিল না। বিশেষত গ্রামের এই রোগ সহজেই মহামারীর আকার ধারণ করত। স্থানীদের মধ্যে এই রোগের নাম ছিল, ‘ওলাওঠা’ বা ‘ওলাউঠা’। ‘ওলা’ মানে নামা বা দাস্ত হওয়া আর ‘উঠা’ মানে উঠে যাওয়া বা বমি হওয়া। অর্থাৎ যে রোগে দাস্ত ও বমি দুইই হয় তাঁকে ‘ওলাউঠা’ বলে। সেই ওলাওঠা রোগ সারিয়ে দেন যে দেবী, তিনিই ওলাইচণ্ডী। স্থানীয় বিশ্বাস, এই দেবীর পুজো করলেই ওলাউঠা রোগ সেরে যায়। তাই বিশেষ আচার মেনে ওলাইচণ্ডী বা ওলাবিবি পুজোর চল রয়েছে বিভিন্ন গ্রামে। এবার আসা যাক দেবীর মূর্তি প্রসঙ্গে। সাধারণত এই দেবীর দু-ধরনের মূর্তি দেখা যায়। হিন্দুপ্রধান অঞ্চলে দেবীর রূপ লক্ষ্মী ও সরস্বতীর মতো। গায়ের রং হলুদ, অত্যন্ত সুশ্রী, মূলত দ্বিনয়না। আবার কোথাও দেবীকে ত্রিনয়না রূপেও দেখা যায়। নানা অলংকারে দেবী মূর্তি সুসজ্জিতা। পরনে মূলত শাড়ি এবং মূর্তিটি সাধারণত দণ্ডায়মান। কোথাও দেবীর বাহন হিসেবে ঘোড়া দেখা যায়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেবী মূর্তিতে কোনও বাহন নেই। কিছু কিছু জায়গায় দেবীর স্রেফ মুন্ডটিকেই পুজো করা হয়। প্রাণপ্রতিষ্ঠা করা হয় ঘটে। তবে মুসলমান-প্রধান অঞ্চলে, অঞ্চলে অর্থাৎ ওলাবিবিরর মূর্তি কিছুটা আলাদা। তার পরনে পিরান বা ঘাগরা জাতীয় পোশাক। মাথায় টুপি ও পায়ে নাগরা জুতো। তবে সেক্ষেত্রেও দেবী মূর্তিতে নানা ধরনের গয়না থাকে।

শাস্ত্রে এই দেবীর তেমন উল্লেখ নেই। তাই এর পুজোর জন্য পঞ্জিকাতেও আলাদা কোনও দিন দেখা যায় না। সেক্ষেত্রে যে কোনও দেবীর পুজো শনি-মঙ্গলবারে করার যে প্রচলিত নিয়ম রয়েছে, ওলাবিবি পুজোর ক্ষেত্রেও সেটিই করা হয়। কিছু কিছু জায়গায় পুজো হয় প্রতি শুক্রবারে। বিশেষ কোনও মন্ত্র নেই। থাকলেই তা অঞ্চল ভেদে ভিন্ন। নেই কোনও পুরোহিতও। যেহেতু লৌকিক দেবী, তাই যে যার নিজের মতো করে দেবীর আরাধনা করেন। কোথাও কোথাও মেয়েদেরও এই দেবীর পুজোয় পৌরহিত্য করতে দেখা যায়। নিত্যপুজোয় আড়ম্বর হয় না বললেই চলে। সন্দেশ, পান-সুপারি, বাতাসা, আতপ চাল, পাটালি ইত্যাদি শুকনো নৈবেদ্যে দিয়ে পুজো সারা হয়। একে বলা হয় ‘মাঙন প্রথা’। এর সঙ্গে আরও এক লৌকিক আচার দেখা যায়, যাকে বলে ছলন বা সলন। কারও মনের ইচ্ছা পূর্ণ হলে, দেবীর থানে ছোট ছোট মূর্তি বসিয়ে যাওয়ার চল রয়েছে। এছাড়া দেবীর বাৎসরিক পুজো বা বিশেষ পুজোও হয়। সেখানে অন্নভোগ বা আরও অনেক কিছু দেওয়া হয়। কখনও ছাগ বলিও হয় ওলাইচণ্ডী মানসিক পুজোয়।

তবে লৌকিক দেবী মানেই যে তিনি স্রেফ গ্রামাঞ্চলে পূজিতা তা নয়। কলকাতাতেও রয়েছে দেবীর মন্দির। চৈত্র মাসে সেখানে বিরাট মেলা বসে। তবে গ্রামের দিকে এই দেবীর মন্দির চোখে পড়ে যথেষ্টই। বিশাল কিছু না হলেও, অন্তত একটা বেদী আর সেখানে প্রতিষ্ঠিত দেবী ওলাইচণ্ডী। আসলে এই দেবীকে গোটা বাংলার লোকসংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র বলা যেতে পারে। একইসঙ্গে দেবীর আরাধনায় সম্প্রীতির নজিরও চোখে পড়ে যথেষ্টই। ইতিহাসবিদরা মনে করেন, ১৯শ শতাব্দীতে ভারতীয় উপমহাদেশে কলেরার দেবী রূপে এই ওলাইচণ্ডীর পূজা শুরু। ধীরে ধীরে দেবীর গুরুত্ব সাম্প্রদায়িক ও বর্ণব্যবস্থার সীমারেখাকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। যদিও আধুনিক যুগে কলেরার চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত হয়েছে। তাই ওলাইচণ্ডীর পূজো কিছুটা হলেও সীমিত হয়েছে। কিন্তু এতদিনের দেবীত্বে ইনি আর স্রেফ কলেরার দেবী নেই। তাই সাধারণ কোনও সমস্যা থেকে মুক্তি পেতেও দেবীর শরণাপন্ন হন ভক্তরা। আর সন্তান স্নেহে তাদের আগলে রাখেন দেবী।

লোক সংস্কৃতি-গবেষক গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসুর মতে, ওলাইচণ্ডী দেবীর আদি নাম ওলাউঠা-চণ্ডী বা ওলাউঠা-বিবি। বিসূচিকা বা কলেরা রোগের অপর নাম ‘ওলাউঠা’ বা ‘ওলাওঠা’ শব্দটি দু’টি প্রচলিত গ্রাম্য শব্দের সমষ্টি – ‘ওলা’ ও ‘উঠা’ বা ‘ওঠা’। ‘ওলা’ শব্দের অর্থ নামা বা মলত্যাগ এবং ‘উঠা’ বা ‘ওঠা’ শব্দের অর্থ উঠে যাওয়া বা বমি হওয়া। হিন্দু-মুসলিম সহ শ্রেণী-বর্ণ নির্বিশেষে সমাজে সকল সম্প্রদায়ের উপাস্য এই দেবী।

প্রচলিত ধ্যান-ধারণা অনুসারে, ওলাইচন্ডী দেবীর পুজো তিন রকমের হয়ে থাকে। প্রতি শনিবার এবং মঙ্গলবার অনাড়ম্বরে যে পুজো হয়, তা বারের পূজা নাম পরিচিত। কারও মানত উপলক্ষে সামান্য আড়ম্বরের সঙ্গে যেকোন‌ও সময়, এই দেবীর পুজো অনুষ্ঠিত হতে পারে। তাছাড়া কোথাও কলেরা রোগ মহামারী আকারে দেখা দিলে, সে এলাকার লোকজন সমষ্টিগতভাবে এই দেবীর পুজো দেন।

এই দেবীকে কেন্দ্র করে প্রচুর প্রবাদ, ইতিহাস, কিংবদন্তি ছড়িয়ে আছে। প্রাচীন কালে ওলাদেবী অসাম্প্রদায়িক দেবী অর্থাত্‍ ধৰ্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এঁর পূজা করা হত। ওলাইচন্ডী দেবীর পূজা এককভাবেও হয়ে থাকে। আবার ঝোলাবিবি, আজগৈবিবি, চাঁদবিবি, বাহড়বিবি, ঝেটুনেবিবি ও আসনবিবি এই ছয়জনের সঙ্গে একত্রেও হয়। এঁদের একত্রে বলা হয় সাতবিবি। কার‌ও কার‌ও মতে এঁরা ব্রাহ্মী, মহেশ্বরী, বৈষ্ণবী, বারাহী, প্রভৃতি পৌরাণিক দেবীর লৌকিক রূপ। শনি ও মঙ্গলের প্রকোপ থেকে বাঁচতে হিন্দু শাস্ত্র অনুসারে এই দেবীর পুজো করা হয়।

অধুনা পাকিস্তান রাষ্ট্রের সিন্ধুপ্রদেশে অবস্থিত প্রাচীন মহেঞ্জোদাড়ো শহরের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে থেকে প্রাপ্ত একটি সিলমোহরে সাতজন নারীকে একসঙ্গে দণ্ডায়মান অবস্থায় দেখা গিয়েছে। আইন-ই-আকবর ও কবি কঙ্কন মুকুন্দরামে চন্ডীতে উলার নাম পাওয়া যায়। শোনা যায়, ১১৭৬ বঙ্গাব্দে তৎকালীন পূজারিণী ব্রহ্মময়ী দেবী উত্তর কলকাতার বেলগাছিয়া অঞ্চলে পরেশনাথ মন্দিরের উল্টোদিকে এক সুবৃহৎ মন্দিরে ওলাইচণ্ডীর শিলামূর্তি স্থাপন করেছিলেন।

কথিত আছে, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়ান কোম্পানির (East India Company) জনৈক কুঠিয়ালের স্ত্রী শ্রীমতী ডনকিং কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে ওলাইচণ্ডী দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। তাঁর স্বামী মি. ডনকিং এক মুসলমান আর্দালিকে সঙ্গে নিয়ে সেই পঞ্চানন মন্দিরে এসে পূজারিণী ব্রহ্মময়ী দেবীকে স্বপ্নের কথা জানালে ব্রহ্মময়ী দেবীই নিকটবর্তী একটি ঝিল থেকে ওলাইচণ্ডীর শিলামূর্তি মাথায় করে নিয়ে এসে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন।

মনসামঙ্গলের (Manasa mangal) কাহিনী অনুসারে প্রায় ৫০০ বছর আগে উলা গ্রামের পাশে গঙ্গা নদী পথে বাণিজ্য করতে যাচ্ছিলেন লখিন্দরের বাবা এবং বেহুলার শ্বশুর চাঁদ সদাগর। কথিত আছে, সে সময় পাথরে ধাক্কা লেগে চাঁদ সদাগরের নৌকা ডুবে যায়। এরপরে স্বপ্নাদেশ পেয়ে উলা গ্রামে শিলাখণ্ড প্রতিষ্ঠা করে মা চন্ডীর আরাধনা শুরু করেন চাঁদ সদাগর।

পশ্চিমবঙ্গের (West Bengal) চব্বিশ পরগনা, কলকাতা, হাওড়া, বর্ধমান, বীরভূম, মেদিনীপুর প্রভৃতি অঞ্চলসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ওলাইচন্ডী দেবীর পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। প্রতি বছরই শুক্লপক্ষের পূর্ণিমা তিথিতে হাজার হাজার লোকের আগমন ঘটে এই পুজোয়, অনুষ্ঠিত হয় মেলাও।

(Collected and edited from several news article)

administrator

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *