ড. শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
তাঁর স্বামী প্রতিদিন বাড়িতে ফিরে স্ত্রীকে শোনান ধর্মের নানান কথা। হাওড়ার পায়রাটুঙ্গির ভাদুড়ী জমিদার বাড়িতে তাঁর স্বামী ক্ষৌরকারের কাজ করেন। তাঁদের দেওয়া জমিতেই বসবাস এই স্বামী – স্ত্রীর। দুজনেই ধর্মে আস্থাশীল। দেব – দ্বিজে গভীর ভক্তি দুজনেরই।
স্ত্রী মুগ্ধ হয়ে স্বামীর কাছে শোনেন নানান ধর্মীয় বিষয়। আশ্চর্য হয়ে ভাবেন – তাঁর স্বামী এতো শাস্ত্র কথা কোথা থেকে জানলেন! জিজ্ঞাসা করলে স্বামী উত্তর দেন – সবই ঠাকুর বাবার কাছ থেকে শোনা। ঠাকুর বাবা মানে আপালচন্দ্র – পার্বতীচরণ ভাদুড়ীর তৃতীয় পুত্র নগেন্দ্রনাথ ভাদুড়ী।
এইভাবেই দিন কাটে দুজনের। হঠাৎ করে একদিন স্ত্রী তাঁর স্বামীকে বললেন – তাঁর খুব ইচ্ছা জগন্নাথ দর্শন করে জগন্নাথদেবের মাথায় জল ঢালার।
এ ঘটনা সেই সময়ের যখন ইচ্ছা করলেই সহজে জগন্নাথ-ধাম পুরীতে পৌঁছানো যেত না। অর্থনৈতিক, সামাজিক, যোগাযোগগত নানা রকম সমস্যা ছিল। তাই জগন্নাথ দর্শনে যাওয়া ছিল আক্ষরিক অর্থেই কার্যত অসম্ভব। দরিদ্র মানুষদের কাছে জগন্নাথ দর্শন বলতে ছিল – যাঁরা জগন্নাথ দর্শন করে এসেছেন তাঁদের কাছ থেকে বিবরণ শোনা আর ছিল পটুয়াদের আঁকা ছবিতে জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা দর্শন। তারপর – সবকিছু মিলিয়ে মনে মনে অনুভবে ছবি আঁকা।
যাইহোক, স্ত্রীর এ কথা শুনে স্বামী অনেকক্ষণ হাসলেন। তারপর বললেন, তার আর দরকার নেই। ঠাকুর বাবাকে দেখে নিলেই হবে। ঠাকুর বাবাই তো স্বয়ং জগন্নাথ।
এ কথার অর্থ ক্ষৌরকারের স্ত্রী বুঝতে পারলেন না। ক্ষৌরকারের স্ত্রী জানতেন ঠাকুর বাবার কথা। এই গ্রামের সবাই তাঁকে খুব ভক্তি করেন। তিনি শুধু জমিদার বাড়ির ছেলে নন, তিনি যে মস্ত বড়ো সাধক। শোনা যায় – গভীর রাতে তিনি আকাশ পথে হেঁটে বেড়ান ! তবু স্বামীর কথা ঠিক পছন্দ হলো না তাঁর। মনে মনে অভিমানও জমলো বেশ খানিকটা।
এদিকে বেশ অনেকদিন কেটে গেছে। একদিন ঐ ক্ষৌরকারের স্ত্রী স্নান করে ফিরছেন। কাঁখে রয়েছে মাটির জলভরা নতুন কলসি। স্নান করে ফেরার এ পথ গ্রামের মেয়ে-বৌদের জন্য। এ পথ পুরুষরা ব্যবহার করেন না। ভাদুড়ীরাই এ ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। ঘটনাচক্রে সেদিন ক্ষৌরকারের স্ত্রী একা। বেশ খানিকটা পথ… তাই একা একা পথ চলায় পথ কিছুটা দীর্ঘ মনে হচ্ছে তাঁর…
হঠাৎই পথ চলতে চলতে তাঁর নজর গেল ভাদুড়ী বাড়ির দিকে। দেখলেন, ভাদুড়ী বাড়ির বেল গাছ তলায় বসে আছেন ঠাকুর বাবা। ধ্যানমগ্ন অবস্থায়। এই জায়গাটা ভাদুড়ীদের মূল বাড়ি থেকে অনেকটাই দূরে। বেশ নির্জন এলাকা। কিছুটা দূর থেকে তাঁকে দেখেই ক্ষৌরকারের স্ত্রীর মনে পড়ল ক্ষৌরকারের বলা কথা। কথাটা মনে পড়তেই আবার খানিকটা অভিমান এসে জমাট হলো। চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা জলও পড়ল।
তারপরই ঘটলো এক আশ্চর্য ঘটনা। হঠাৎ করেই তিনি দেখতে পেলেন ঐ বেল গাছের ওখানে এক আশ্চর্য জ্যোতি! আর সেই জ্যোতির মধ্যে বসে আছেন স্বয়ং জগন্নাথ। ঠিক তিনি যেমন দেখেছিলেন পটে আঁকা ছবিতে! মাটি থেকে অনেকটা উঁচুতে বসে আছেন জগন্নাথ! একটার পর একটা ধাপ উঠে গেছে। সেই ধাপগুলোর শেষ ধাপে বসে আছেন স্বয়ং জগন্নাথ!
তিনি ভাবলেন তিনি ভুল দেখছেন। কিন্তু আশ্চর্য – তা তো নয়। সত্যিই তো জগন্নাথদেব! যাঁকে তিনি দর্শন করতে চেয়েছিলেন। সেই রকম অদ্ভুত চোখ! সেই একই রকম চেহারা!
নিজেকে সামলাতে পারলেন না ক্ষৌরকারের স্ত্রী। উপস্থিত হলেন সামনে। কিন্তু তিনি জল ঢালবেন কেমন করে ? জগন্নাথদেব যে অনেক ওপরে। অনেকগুলো ধাপ ওপরে। এতো কিছুর পরেও বুঝি শেষ রক্ষা হলো না। পূর্ণ হলো না শেষ ইচ্ছা।
আশ্চর্য – দেখা গেল জগন্নাথদেব কৃপা করে নেমে এসেছেন ঠিক যেন মাটি থেকে সামান্য ওপরে। আর এবার শুধু জগন্নাথ নন, সঙ্গে বলরাম এবং সুভদ্রাও আছেন। ঠিক যেমন তিনি দেখেছিলেন পটে আঁকা ছবিতে।
ক্ষৌরকারের স্ত্রী অঝোর ধারায় কাঁদছেন আর ভাবছেন – জগন্নাথ এতো দয়াময়! এতো কৃপাময়!
শেষ পর্যন্ত তাঁর কলসিতে থাকা ঐ জলই তিনি ঢেলে দিলেন জগন্নাথের মাথায়। বারবার প্রণাম করতে লাগলেন জগন্নাথদেবকে।
বেশ কিছুক্ষণ পর তিনি দেখলেন – জগন্নাথ আর নেই। ঠাকুর বাবা বসে আছেন। তখনও ধ্যানমগ্ন আগের মতোই।…
তাঁর যে রূপ দর্শনের জন্য জন্ম-জন্মান্তর চলে যায়, যে কৃপা প্রাপ্তির জন্য মহাযোগীকেও কঠিন তপস্যার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় – শুধু মন নির্মল হওয়ায় সেই কৃপালাভেই ধন্য হলেন এক নারী। স্থূলের উপাসনা থেকেই যে আসে সূক্ষ্ম রূপে অধিকার :
“যাবন্ন জায়েত পরাবরেঽস্মিন্
বিশ্বেশ্বরে দ্রষ্টরি ভক্তিযোগঃ ।
তাবৎ স্থবেয়ুঃ পুরুষস্য রূপম্
কৰ্ম্মাবসানে প্রযতঃ স্মরেত ॥”
তাই তো তিনি দেখতে পেলেন বাইশ সোপান – “বাইশ পহছা” । অর্থাৎ অষ্ট বৈকুণ্ঠ, চতুর্দশ ভুবন। এগুলোকে অতিক্রম করেই যে তাঁর কাছে পৌঁছাতে হয়। তাই তো জগন্নাথ অতো দূরে, অতো উঁচুতে! আবার এতো কাছেও! আর সেই সাথেই তিনি পেলেন সেই দর্শন –
“অনাদিমধ্যান্তমনন্তবীৰ্য্যম্
অনন্তবাহুং শশিসূৰ্য্যনেত্রম্ ।
পশ্যামি ত্বাং দীপ্ত-হুতাশ- বক্ত্রং
স্বতেজসা বিশ্বমিদং তপন্তং ৷।”
-শ্রীভগবান অর্জুনকে যে বিশ্বরূপ দেখিয়েছিলেন, জগন্নাথ রূপ যে তারই আভাস। আবার এই শ্রীক্ষেত্রই সেই পরমক্ষেত্র যেখানে বিশ্বনাথ দর্শন জগন্নাথ দর্শনের মতোই ফলপ্রদ। বিশ্বনাথ দর্শন করে তবেই জগন্নাথের দর্শন করতে হয়। তিনি পুরুষোত্তম। ধরা-ছোঁয়ার একেবারে বাইরে। শুধু তাঁর কৃপাতেই সম্ভব তাঁকে প্রত্যক্ষ করা। সেই কৃপাই করলেন পরমহংস মহর্ষি নগেন্দ্রনাথ। যিনি কাশীতে দর্শন দেবেন বিশ্বনাথের রূপে আর এখানে দর্শন দিলেন দারুব্রহ্ম জগন্নাথের রূপে। যিনি যে বহিরঙ্গে শিব, অন্তরঙ্গে বিষ্ণু।
তথ্য ঋণ যাঁদের কাছে :
প্রয়াত ড. রঘুপতি মুখোপাধ্যায়, অশোক ভট্টাচার্য।