www.machinnamasta.in

ওঁ শ্রীং হ্রীং ক্লী গং গণপতয়ে বর বরদ সর্বজনস্ময়ী বশমানয় ঠঃ ঠঃ

August 3, 2025 10:11 pm

এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটলো সেদিন। ভাদুড়ীদের পায়রাটুঙ্গির জমিদার বাড়িতে বসেছে রামায়ণ গানের আসর। রামায়ণ গান করতে এসেছেন একজন মহাপণ্ডিত। একটি অংশে তিনি স্বরচিত শ্লোক পাঠ করবেন। কিন্তু স্মৃতি থেকে উচ্চারণের সময় তিনি ভুলে গেলেন সেই শ্লোকের বেশ কিছুটা অংশ। হঠাৎ করেই সদ্য পৈতে হওয়া আপালচন্দ্র, পরবর্তীকালের পরমহংস - মহর্ষি নগেন্দ্রনাথ বলে দিলেন সেই অংশ। ঐ মহাপণ্ডিত আশ্চর্য ! কারণ পুঁথির মধ্যে লিখে রাখা ঐ শ্লোক ঐ পণ্ডিত ছাড়া আর কেউ জানেন না। আসরে আসার আগে তিনি লিখেছেন সেই শ্লোক এবং পুঁথিতে তা লেখার সময় সেখানে আর কেউ উপস্থিত ছিলেন না!

ড. শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

তখন সদ্য পৈতে হয়েছে হাওড়ার পায়রাটুঙ্গির ভাদুড়ী জমিদার বাড়ির পার্বতীচরণ ভাদুড়ীর তৃতীয় পুত্র আপালচন্দ্র অর্থাৎ নগেন্দ্রনাথের। সেই উপলক্ষে ভাদুড়ী বাড়িতে আয়োজন করা হয়েছে রামায়ণ গানের। কারণ এ নামের মাহাত্ম্য যে বেদের সমান – “বেদৈশ্চ সম্মিতম”।

রামায়ণ গান করতে ভিন গাঁ থেকে আসছেন এক মহাপণ্ডিত। শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত হিসেবে তাঁর সুনাম চারিদিকে।

বিকেল থেকে বসবে রামায়ণ গানের আসর। জমিদারির প্রজারা আসবেন সেই গান শুনতে। সেই জন্য সকাল থেকেই চলছে প্রস্তুতি।

নির্দিষ্ট সময়ের বেশ কিছুটা আগেই ভাদুড়ী বাড়িতে চলে এলেন ঐ পণ্ডিত। অনেকেই এলেন তাঁর সাথে দেখা করতে। একে তিনি মহাপণ্ডিত তার ওপর তাঁর শৈশব এবং কৈশোরের দীর্ঘ সময় কেটেছে তীর্থক্ষেত্র বারাণসীতে। তাই দলে দলে মানুষ আসছেন তাঁকে দর্শন করতে। এলেন আপালচন্দ্রও। রামানন্দী সম্প্রদায়ের এই পণ্ডিত জানতেন এই ছেলের জন্যই রামায়ণ গানের আয়োজন। তাই আপালচন্দ্রকে তিনি গায়ত্রী প্রসঙ্গে বেশ কিছু উপদেশ দিলেন আর বললেন মন দিয়ে রামায়ণ পাঠ শুনতে। সেই সঙ্গেই তিনি জানালেন, আজ রামায়ণ গানের সময় তিনি ভগবান রামের ওপর লেখা একটি শ্লোক পাঠ করবেন। সেই শ্লোকটি তিনি এখানে বসেই রচনা করবেন। তাই তাঁকে যেন নির্জনে থাকতে দেওয়া হয়।

সেই ব্যবস্থাই হলো। তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হলো একটি নিভৃত কক্ষ। তাঁর সঙ্গীদের বিশ্রামের ব্যবস্থা করা হলো অন্য আরেকটি কক্ষে।

এরপর যথাসময়ে শুরু হলো রামায়ণ গান। একদিকে সংস্কৃত উচ্চারণ অন্যদিকে গান গেয়ে গেয়ে তার ব্যাখ্যা – সবাই মন্ত্রমুগ্ধ। সদ্য পুত্রকে হারিয়েছেন ঐ পণ্ডিত। তাঁর কণ্ঠে যেন সেই বেদনা আজ সমর্পণের ভাবে মুখর। তাঁর দুচোখ বেয়ে নেমে আসা অশ্রু যেন গঙ্গাজল।

হঠাৎ করেই এল সেই অংশ। পণ্ডিত ঘোষণা করলেন – এবার তিনি সেই শ্লোক পাঠ করবেন যা এখানে এসে তিনি লিখেছেন।

কিন্তু কিছুটা শ্লোক স্মৃতি থেকে পাঠ করার পর হঠাৎ করেই তিনি ভুলে গেলেন পরবর্তী অংশ। নিজের শ্লোক লেখার পর তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল নিজের স্মৃতির ওপর। কারণ এক – দুবার তিনি যে শ্লোক পড়তেন বা যা তিনি নিজে লিখতেন – তা তাঁর স্মৃতিতে রয়ে যেত। এ এক অলৌকিক ক্ষমতা ছিল তাঁর। তাই শ্লোক ভুলে যাওয়ায় তিনি আশ্চর্য হলেন। পরিস্থিতি সামাল দেবার জন্য দ্রুত নিজের হাতে ধরা পুঁথি খুলে সেই অংশটি পড়বার চেষ্টা করলেন।

হঠাৎ দেখা গেল আপালচন্দ্র উঠে দাঁড়িয়ে সেই শ্লোক বলতে শুরু করে দিয়েছেন। শুদ্ধ উচ্চারণে তিনি বলছেন পরবর্তী অংশ। অবাক হয়ে গেলেন পণ্ডিত। এই অংশ যখন তিনি লিখেছেন তখন তো আর কেউ ছিলেন না। তবে আপালচন্দ্র কেমন করে জানলেন সেই শ্লোক! আর কেমন করেই বা তা বলছেন এমন শুদ্ধ উচ্চারণে আপালচন্দ্র – এই বয়সে!

বিস্ময় চেপে রাখতে না পেরে পণ্ডিত নিজেই জিজ্ঞাসা করলেন সবার সামনেই সে কথা। আপালচন্দ্র হেসে বললেন, তাঁর হাতে ধরা পুঁথিতে যা লেখা আছে পুঁথি বন্ধ থাকলেও তা তিনি দেখতে পাচ্ছেন। আর তাছাড়া তিনি যখন তিনি সেই শ্লোক লিখেছেন আপালচন্দ্র তখন সেখানেই তো ছিলেন।

পণ্ডিত বুঝলেন, আসল সত্য। বন্ধ পুঁথি দেখে যে ছেলে ভেতরের লেখা পড়তে পারেন তিনি সাধারণ কেউ নন! আর শ্লোক লেখার সময় তিনি তো ভগবান রামচন্দ্রকে স্মরণ করেছিলেন। তাঁকেই তো বলেছিলেন উপস্থিত থাকতে। তবে এই ছেলেই সেই ! তাঁর আরাধ্য ! ইষ্ট দেবতা !

এবার সভার মধ্যেই আপালচন্দ্রের পায়ের ওপর লুটিয়ে পড়লেন সেই মহাপণ্ডিত। পাণ্ডিত্যের গর্ব তাঁর আর নেই। নেই পুত্র বিয়োগের শোকও। এখন তিনি শরণাগত। সকল কারণের কারণরূপে যিনি অবতীর্ণ – আজ তিনি শরণ নিয়েছেন তাঁরই পাদপদ্মে :
“যৎপাদঃ প্লবমিব ভাতি হি ভবাম্বোধেস্তীতীর্ষাবতাম / বন্দেঽহং তমশেষকারণপরং রামাখ্যমীশং হরিম্।”

এতোদিন তিনি ধরতে চেয়েছিলেন তাঁর আরাধ্যকে। কারণ ধর্মের সারভূত যে মহাদ্রুম তার মূল তো তিনিই, জগতের সমস্ত মানুষ তো সেই জ্যোতির্ময় বৃক্ষেরই পত্র, শাখা, ফল, ফুল –
“মূলং হ্যেষং মনুষ্যাণাং ধর্মসারো মহাদ্যুতিঃ।
পুষ্পং ফলঞ্চ পত্রঞ্চ শাখাশ্চাস্যেতরে জনাঃ।। “

আজ সেই তিনিই ধরা দিলেন নিজে থেকে। একদিন যেমন নিজে থেকেই ধরা দিয়েছিলেন বালক কৃষ্ণ – ” কৃষ্ণঃ কৃপয়াসীৎ স্ববন্ধনে”।

এ যে তাঁর জন্ম- জন্মান্তরের সৌভাগ্য। এই যে প্রত্যক্ষ অনুভূতির দ্বারা আত্ম-উপলব্ধি, তাই তো প্রকৃত ধর্ম। গুহ্যতত্ত্ব থেকেও গুহ্যতর। অব্যয় ভক্তিতত্ত্ব :
“রাজবিদ্যা রাজগুহ্যং পবিত্রমিদমুত্তমম্।
প্রত্যক্ষাবগমং ধর্মং সুসুখম্ কতুমব্যয়ম্।।”

এতোদিন পণ্ডিত তাঁর ইষ্ট দেবকে অনুভবের চেষ্টা করেছিলেন। শোক থেকে জন্ম দিতে চেয়েছিলেন একের পর এক শ্লোকের। আজ পণ্ডিত তাঁর সেই ইষ্টের কৃপাতেই বুঝলেন – এ জগত তাঁরই আশ্রিত। তিনি যে কে – তা না জানা পর্যন্ত কিছুতেই এই জগতের মিথ্যা দুঃখ যায় না –
“এহি বিধি জগ হরি আস্রিত রহঈ।
জদপি অসত্য দেত দুখ অহঈ।।
জৌ সপনে সির কাটই কোঈ ।

বিনু জাগে ন দুরি দুখ হোঈ ৷৷”…

তথ্য ঋণ যাঁদের কাছে :
প্রয়াত ড. রঘুপতি মুখোপাধ্যায়, অশোক ভট্টাচার্য।

administrator

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *