ড. শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
তাঁর তিন পুত্র বাংলা সঙ্গীত জগতের তিন নক্ষত্র – সুরকার প্রফুল্ল ভট্টাচার্য, স্বর্ণকণ্ঠশিল্পী ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য এবং সাধক শিল্পী পান্নালাল ভট্টাচার্য। তিনি নিজেও ছিলেন সে যুগের প্রখ্যাত শিল্পী। তাঁর হাতে সুরে সুরে কথা বলত কখনও এস্রাজ। কখনও সেতার।…
নির্মোহ মনোভাব ছিল সুরেন্দ্রনাথের স্বভাব সঙ্গী। নিজে ছিলেন হাওড়া জেলার ধারসার পায়রাটুঙ্গি গ্রামের জমিদার পরিবারের সন্তান। চাকরি করতেন বিএনআর-এ। পূর্বপুরুষের প্রচুর সম্পত্তিও বংশানুক্রমে পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সম্পত্তি নিয়ে স্বজনদের সঙ্গে অশান্তি শুরু হলে সুরেন্দ্রনাথ চলে আসেন হাওড়ার আমতা-য়। থাকতে শুরু করেন একটি ভাড়াবাড়িতে। সেখান থেকে চলে আসেন বালি বারেন্দ্র পাড়ায়। এখানেই গৃহ নির্মাণ করান সুরেন্দ্রনাথ।

পান্নালাল ভট্টাচার্য
নিজে ছিলেন ভাদুড়ী বংশের সন্তান। বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ। এই ভাদুড়ী বংশেরই মহান সন্তান রাজা গণেশ, উদয়নাচার্য ভাদুড়ী, ‘The Levitating Saint’ – হিসেবে যিনি পৃথিবী বিখ্যাত সেই – ভাদুড়ী মহাশয় অর্থাৎ মহর্ষি নগেন্দ্রনাথ।
কিন্তু ভাদুড়ী হলেও সুরেন্দ্রনাথ ব্যবহার করতেন ভট্টাচার্য। শোনা যায় পৌরোহিত্যের কারণেই তাঁরা পেয়েছিলেন এই ভট্টাচার্য। অবশ্য পারিবারিক সূত্রে এও শোনা যায় যে- বর্ধমানের মহারাজা এই বংশের কোনও পুরুষকে ভট্টাচার্য উপাধি প্রদান করেন।
সুরেন্দ্রনাথের পরিবার দেবী লক্ষ্মীর আশীর্বাদ ধন্য হলেও দেবী সরস্বতীর কৃপা থেকেও বঞ্চিত ছিল না। মহর্ষি নগেন্দ্রনাথ শুধু একজন সিদ্ধ যোগী কিংবা একজন বহু ভাষাবিদ শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত ছিলেন না, ছিলেন একজন সঙ্গীতজ্ঞও। বালি ইংলিশ হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক থাকাকালীন ১৮৮১ সালে দক্ষিণেশ্বরে রামকৃষ্ণ পরমহংসের সঙ্গে নগেন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ হয়। এই মহান ঘটনার উল্লেখ আছে ‘COMPANIONS AND FOLLOWERS OF RAMAKRISHNA’ গ্রন্থটিতে। মহর্ষি নগেন্দ্রনাথ দক্ষিণেশ্বরে রামকৃষ্ণ পরমহংসের উপস্থিতিতে তিনটি গান পরিবেশন করেন। মহর্ষি নগেন্দ্রনাথের লিখিত এবং সুরারোপিত এই সমস্ত সঙ্গীত পরমার্থ সঙ্গীত নামে প্রসিদ্ধ। এই পরমার্থ সঙ্গীতেরই সংকলন ‘পরমার্থ-সঙ্গীতাবলী’। সুরেন্দ্রনাথও বংশের এই ধারায় সঙ্গীতে যথেষ্ট জ্ঞান লাভ করেছিলেন। সে যুগে সেতার এবং এস্রাজ বাদক হিসেবে সুরেন্দ্রনাথ যথেষ্ট সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন।

মহর্ষি নগেন্দ্রনাথ ভাদুড়ী
সুরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হন অন্নপূর্ণা দেবীর সাথে। তাঁদের তিন পুত্র বাংলা সঙ্গীত জগতের তিন নক্ষত্র – সুরকার প্রফুল্ল ভট্টাচার্য, স্বর্ণ কণ্ঠশিল্পী ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য এবং সাধক শিল্পী পান্নালাল ভট্টাচার্য। তাঁর এবং অন্নপূর্ণা দেবীর এগারো জন সন্তানের মধ্যে সাধক শিল্পী পান্নালাল ভট্টাচার্য ছিলেন সবার ছোটো। পান্নালাল ভট্টাচার্য যখন সাত মাসের মাতৃগর্ভে তখন হঠাৎই সুরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য প্রয়াত হন।

ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য
তারপরের কাহিনি সংগ্রামের। রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ পরিবারের বিধবা মা অন্নপূর্ণার সঙ্গে তাঁর সন্তানদের জীবন সংগ্রামে বেঁচে থাকার। পিতার রেখে যাওয়া সুরের উত্তরাধিকারের সূত্র ধরে তিন পুত্রের অস্তিত্ব রক্ষা করে মাথা তুলে দাঁড়ানোর…
লেখকের মাতামহ সুরকার প্রফুল্ল ভট্টাচার্য।
অঙ্কিত ছবিগুলি লেখকের অঙ্কন। মহর্ষি নগেন্দ্রনাথের ছবিটি শ্রীশ্রীনগেন্দ্র মঠ এবং নগেন্দ্র মিশনের ও অন্য ছবিগুলি ভট্টাচার্য পরিবারের সৌজন্যে প্রাপ্ত।

প্রফুল্ল ভট্টাচার্য