শনিবার বিশ্বকর্মা পূজা (Biswakarma Puja) । ভাদ্র মাসের শেষ দিনে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়। হিন্দু পুরান অনুযায়ী, বিশ্বকর্মা হলেন দেবশিল্পী। তো, যাই হোক বিভিন্ন কলকারখানা, সুতার, মিস্ত্রি স্বর্ণকার থেকে শুরু করে অনেকেই এই পূজো করে থাকেন নিজের বাড়িতেও।
তাই, বিশ্বকর্মা পূজোর আগে চলুন জেনে নেওয়া যাক এই পূজোর বিভিন্ন মন্ত্র, পূজা পদ্ধতি, সরঞ্জামের মতো আরো বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
বিশ্বকর্মা পূজার উপকরণ
বিশ্বকর্মা পূজা – সিন্দুর, পুরোহিত বরণ ১, তিল, হরিতকী, পঞ্চগুঁড়ি, পঞ্চগব্য, পঞ্চশস্য, পঞ্চরত্ন, পঞ্চপল্লব, ঘট ১, কুন্ডহাঁড়ি ১,তেকাঠা ১, দর্পণ ১, তীর ৪, ঘটচ্ছাদন গামছা ১, বরণডালা, সশীষ ডাব ১, একসরা আতপ তণ্ডুল, পুষ্প, দূর্ব্বা, তুলসী, বিল্ল্বপত্র, ধূপ, দীপ, ধুনা, বিশ্বকর্মার ধুতি ১, আসনাঙ্গুরীয়ক ১, মধুপর্কের বাটী, ঘৃত, দধি, মধু, নৈবেদ্য ১, কুচা নৈবেদ্য ১, চন্দ্রমালা ১, পুষ্পমালা ১, থালা ১, ঘটি ১, পান, পানের মশলা, বালি, কাষ্ঠ, খোড়কে, গব্যঘৃত ১ পোয়া, পূর্ণপাত্র ১, আরতি ও দক্ষিণা।
বিশ্বকর্মা পূজার মন্ত্র
বিশ্বকর্মার ধ্যান মন্ত্র
ওঁ বিশ্বকর্মন্ মহাভাগ সুচিত্রকর্মকারক্ । বিশ্বকৃৎ বিশ্বধৃক্ ত্বঞ্চ রসনামানদণ্ডধৃক্ ।।
এর অর্থ- হে দংশপাল (বর্মের দ্বারা পালনকারী), হে মহাবী , হে বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা ও বিশ্ব বিধাতা, হে সুন্দর চিত্র রূপ কর্মকারক, আপনি মাল্য চন্দন ধারন করে থাকেন।
বিশ্বকর্মার প্রনাম মন্ত্র
দেবশিল্পি মহাভাগ দেবানাং কার্য্যসাধক । বিশ্বকর্মন্নমস্তুভ্যং সর্বাভীষ্টপ্রদয়ক ।।
দেবশিল্পী , মহাভাগ (দয়াদি অষ্ট গুন যুক্ত) দেবতা দের কারু কার্য্যসাধক সর্বাভীষ্ট প্রদানকারী হে বিশ্বকর্মা আপনাকে নমস্কার।
ধ্যান ও প্রনাম মন্ত্রে বিশ্বকর্মার যে পরিচয় পাওয়া গেলো- সেটি হল বিশ্বকর্মা মহাবীর আবার দয়াদি অষ্ট গুন যুক্ত। তিনি সৃষ্টি কর্তা আবার সৃষ্টি বিধাতা। তিনি মহাশিল্পী আবার মহাযোদ্ধা। বিশ্বকর্মার এই চরিত্র বেদ এবং পুরানে আরোও পরিষ্কার ভাবে ফুটে উঠে।
পুরান শাস্ত্রে বিশ্বকর্মা
বেদের যিনি বিশ্ব স্রষ্টা, পুরানে তিনি দেবতা দের শিল্পী বিশ্বকর্মা। তিনি স্বর্গের একজন দেবতা । তিনি সহস্র রকম শিল্প জানেন। তিনি দেবতা দের শিল্পের কারিগর।
কারিগরি সকল বিদ্যা বিশ্বকর্মার হাতে। কোন কোন পুরান বলে বিশ্বকর্মার পিতা হলেন প্রভাস। প্রভাস হলেন অষ্টবসুর এক জন। আর বিশ্বকর্মার মাতা হলেন বরবর্ণিনী। বরবর্ণিনী হলেন দেবগুরু বৃহস্পতির ভগিনী। আবার ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরান বলে ব্রহ্মার নাভি থেকে বিশ্বকর্মার সৃষ্টি। পুরানের বিশ্বকর্মা একজন শিল্পী। তিনি বিমান নির্মাতা(দিব্য দেব বিমান), অলংকার ভূষন, আয়ূধ প্রস্তুতকারক। মনুষ্য শিল্পীরা বিশ্বকর্মার প্রবর্তিত শিল্প কেই উপজীব্য করে বেঁচে আছে। বিশ্বকর্মা প্রচুর জিনিষ নির্মাণ করেছেন। কুঞ্জর পর্বতে অবস্থিত অগস্ত্য মুনির ভবন, কুবেরের অলকা পুরী ও দিব্য বিমান, রাবনের স্বর্ণ লঙ্কা, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দ্বারকা পুরী – সকল কিছু বিশ্বকর্মার দ্বারা সৃষ্টি।
বিশ্বকর্মা পূজার পাঁচালী
রাবনের রাজাপ্রসাদের সাথে সুন্দর উদ্যান, গোষ্ঠ, মন্ত্রণা গৃহ, মনোরম ক্রীড়া স্থান, রাজাপ্রাসাদের কারুকার্য ইত্যাদি দেবশিল্পীর নিখুত শিল্প কলার পরিচয় দেয়। এছাড়া ভাগবত পুরান অনুসারে দ্বারকা নগরীর যে সুরক্ষিত, ভাস্কর্য , কলা কৌশলের একটি ধারনা পাওয়া যায়- তাতে শিল্পী বিশ্বকর্মার শিল্প কে দেখে আশ্চর্য হতে হয়। বিশ্বকর্মার অপর নির্মাণ হল দেবপুরী। তিনি সমস্ত সৌন্দর্য কে মিলিয়ে এই পুরী নির্মাণ করেছিলেন। এই পুরীকে পাওয়ার জন্য বারংবার অসুর গণ সুর লোকে হানা দিয়েছিলেন। তাই বিশ্বকর্মার সৃষ্টিকে প্রনাম না করে থাকা যায় না।
মৎস্য পুরান বলে- কি কূপ, কি প্রতিমা, কি গৃহ, কি উদ্যান সকল কিছুর উদ্ভাবক হলেন বিশ্বকর্মা। শুধু এখানেই বিশ্বকর্মার সৃষ্টি শেষ নয়, যে বিমানে চড়ে দেবতারা গমন করেন- তাও বিশ্বকর্মার তৈরী। এবং বিভিন্ন দিব্য বান- যা কেবল দেবতাদের অস্ত্রাগারে থাকে – তাও বিশ্বকর্মার তৈরী। যে ধনুক দিয়ে ভগবান শিব ত্রিপুরাসুরকে বধ করেছিলেন, যে ধনুক পরশুরামের কাঁধে শোভা পেতো- সেই ধনুক বিশ্বকর্মার সৃষ্টি। বৃত্রাসুর বধের জন্য বিশ্বকর্মা দধীচি মুনির অস্থি থেকে বজ্র নির্মাণ করে দেবেন্দ্র কে দিয়েছিলেন। কিছু পুরান বলে ভগবান বিষ্ণুর চক্র, ভগবান শিবের ত্রিশূল বিশ্বকর্মার সৃষ্টি। শ্রী শ্রী চন্ডীতে দেখি মহিষাসুর বধের জন্য দেবী মহামায়া প্রকট হলে দেবীকে তীক্ষ্ণ বর্শা, অভেদ্য কবচ এবং বহু মারনাস্ত্র বিশ্বকর্মা দেবীকে প্রদান করেন । রামচন্দ্রের সেতু বন্ধনের অন্যতম কারিগর নল এই বিশ্বকর্মার পুত্র।
বিষ্ণু পুরান বলে ত্বষ্টা নামক এক শিল্পী ছিল- যিনি বিশ্বকর্মার পুত্র। দেবতাদের শিল্পী যেমন বিশ্বকর্মা, তেমনি অসুর দের শিল্পী হলেন ময় দানব। বায়ু পুরান ও পদ্ম পুরান মতে ভক্ত প্রহ্লাদের কন্যা বিরোচনার সাথে বিশ্বকর্মার বিবাহ হয়। বিশ্বকর্মার ঔরসে বিরোচোনার গর্ভে অসুর শিল্পী ময় দানবের জন্ম হয়।
ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরান মতে বিশ্বকর্মা ও তাঁর স্ত্রী ঘৃতাচী দুজনেই শাপ পেয়ে ধরাধামে জন্ম নেন। ঘৃতাচী ছিলেন স্বর্গের এক নর্তকী। তাঁদের নয়টি সন্তান হয় – যথা মালাকার, কর্মকার, কাংস্যকার, শঙ্খকার, সূত্রধর, কুবিন্দক, কুম্ভকার, স্বর্ণকার, চিত্রকর। বিশ্বকর্মা প্রত্যেক কেই নানান শিল্প শেখান। তিনি মালাকারকে পুস্প শিল্প, কর্মকারকে লৌহ শিল্প, কাংস্যকারকে কাংস শিল্প, শঙ্খ কারকে শঙ্খ শিল্প, সূত্রধরকে কাষ্ঠ শিল্প, কুবিন্দক কে বয়ন শিল্প, কুম্ভকারকে মৃৎ শিল্প, স্বর্ণকারকে অলঙ্কার শিল্প, চিত্রকরকে অঙ্কন শিল্প শেখান। স্কন্ধ পুরান বলে বৃত্রাসুর হলেন বিশ্বকর্মার পুত্র। যাকে ইন্দ্র দেবতা বধ করেন। তবে স্কন্ধ পুরানের এই মত অপর কোন পুরানে পাওয়া যায়নি।
এত সর্তেও বলা যায় বিশ্বকর্মার এক মেয়ে পিতার অমতে বিয়ে করেছিল। এই কারনে বিশ্বকর্মা বানর হয়ে পৃথিবীতে জন্মান। ঘটনাটি এই- বিশ্বকর্মা ও ঘৃতাচীর কন্যা চিত্রাঙ্গদা পৃথিবীর সূর্য বংশীয় রাজা সুরথ কে ভালোবাসতো। সুরথও চিত্রঙ্গদা কে ভালোবাসতো। কিন্তু দেবতা হয়ে ত মানুষের সাথে বিবাহ হয় না । বিশ্বকর্মা জানতে পেরে মেয়েকে যথেষ্ট শাসন করলেন। এই অবস্থায় পৃথিবীর মেয়েরা যা করে বিশ্বকর্মার কন্যা টিও তাই করলো। স্বর্গ থেকে পালালো। দুজনে বিবাহ করে নিলো। ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে বিশ্বকর্মা আসলেন। কন্যা ভাবলেন পিতা বুঝি আশীর্বাদ করতে এসেছেন। কিন্তু না। বিশ্বকর্মা অভিশাপ দিলেন। কন্যার বিবাহ বিচ্ছেদ হোক – এমন অভিশাপ দিলেন। কিন্তু সনাতন ধর্মে বিবাহকে খুব পবিত্র সম্পর্ক মানা হয়- যেখানে বিবাহ বিচ্ছদের স্থান নেই।
তাই মহর্ষি ঋতধ্বজ ভাবলেন দেবতা হয়ে বিশ্বকর্মার একি পশুর মতো বুদ্ধি? মুনি বিশ্বকর্মা কে বানর কূলে জন্মাবার শাপ দিলেন। বিশ্বকর্মা বানর হলেন। অবশেষে এক সময় কন্যার বিবাহ মেনে নিলে কন্যা ও বিশ্বকর্মা দুজনেরই শাপ দূর হয়।